প্রায় ৩৫,০০০ প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ করা হইবে। আবেদনপত্র জমা পড়িয়াছে ৫৪,৫০০০০টি। অর্থাৎ প্রতিটি খালি পদের জন্য প্রায় ১৬০ জন লড়িতেছেন। যে রাজ্যের ঘটনা, তাহার নামোল্লেখ বাহুল্যমাত্র। লক্ষণীয়, যাঁহারা আবেদন করিয়াছেন, তাঁহাদের অধিকাংশই স্নাতক। এই দুর্ভাগা রাজ্যটিতে এত জন শিক্ষিত মানুষ শিশুশিক্ষার স্বার্থে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করিতে চাহিতেছেন, এমন ভাবিতে পারিলে আনন্দের কারণ হইত। কিন্তু বাস্তব সেই সুখস্বপ্নকে রূঢ় ভাবে প্রত্যাখ্যান করিতেছে। বাস্তব হইল, এই রাজ্যে চাকুরি নাই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরি এমন কিছু লোভনীয় নহে। ভদ্রতর বিকল্প থাকিলেও প্রাথমিক শিক্ষকতাকেই জীবনের লক্ষ্য মানিবেন, এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা খুব বেশি হইবার কথা নহে। অনুমান করা চলে, অধিকাংশই অন্য চাকুরি পাইলে স্বেচ্ছায় এবং স্বচ্ছন্দে তাহা করিতেন। পশ্চিমবঙ্গে অন্য চাকুরি নাই, ফলে প্রাথমিক শিক্ষকতাই ভরসা। আর সেই ভরসারই বা কী নমুনা! যদি সব কয়টি শূন্য পদ পূরণ করা হয়, তবুও প্রতি একশত জনে চাকুরি জুটিবে ০.৬২ জনের। বাকি ৯৯.৩৮ জন যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই থাকিবেন। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে তিমিরই মুখ্য। রাজ্যবাসীর অভ্যাস হইয়া গিয়াছে।
পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা দুই ধাপের। দ্বিতীয় ধাপটি অধিকতর আলোচিত এই রাজ্যে শিল্প নাই, ফলে কর্মসংস্থানও নাই। কিন্তু অপেক্ষাকৃত অনালোচিত প্রথম ধাপটি কম গুরুত্বপূর্ণ নহে আধুনিক ক্ষেত্রে চাকুরি করিবার যোগ্য ছাত্রছাত্রী তৈরি করিবার কোনও ব্যবস্থা এই রাজ্যে নাই। যে সাড়ে চুয়ান্ন লক্ষ স্নাতক প্রাথমিক শিক্ষক হইবার জন্য লড়িতেছেন, অনুমান করা চলে, তাঁহাদের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষায় সবিশেষ আগ্রহী ছিলেন না, যোগ্যও নহেন। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পর যদি পেশাদারি প্রশিক্ষণের যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকিত, এবং সেই পথে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা থাকিত, এই সাড়ে চুয়ান্ন লক্ষের অনেকেই স্নাতক স্তরে তিনটি বৎসর নষ্ট করিতেন না। পশ্চিমবঙ্গে সেই সুযোগ নাই, অগত্যা স্কুলের গণ্ডি পার হইলে স্নাতক স্তরের কলেজই একমাত্র গন্তব্য। যাঁহারা স্নাতক হন, তাঁহাদেরও অধিকাংশই যে নিয়োগযোগ্য নহেন, এই কথাটিও শিল্পমহল বহু বার স-উদ্বেগ জানাইয়াছে। বামফ্রন্টের আশীর্বাদে তাঁহারা ইংরাজি জানেন না, পরিকাঠামোর অভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রেও জ্ঞান হয় না। তাঁহাদের কে-ই বা নিয়োগ করিবে? সমস্যাটি অবশ্য শুধু সাধারণ স্নাতকদের ক্ষেত্রেই নহে, ইঞ্জিনিয়ারিং স্নাতকদের ক্ষেত্রেও সত্য। তবু তাঁহাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার জোরে চাকুরি জোটে। তবে এই রাজ্যে নহে। তাঁহাদের ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিতে হয়। একটি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলিতেছে, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হইতে যাঁহারা পাশ করিতেছেন, তাঁহাদের তিন-চতুর্থাংশেরই চাকুরি হইতেছে পশ্চিমবঙ্গের বাহিরে। কারণ সহজ এই রাজ্যে শিল্প নাই। ভবিষ্যতে থাকিবে, সেই ভরসাও নাই। শিল্প না থাকিলে চাকুরিও নাই। ইঞ্জিনিয়ারদেরও নহে, অন্যদেরও নহে। ইঞ্জিনিয়ারদের ভরসা ভিন্ রাজ্য, আর অন্যদের প্রাথমিক বিদ্যালয়।
দুইটি সমস্যার সমাধানেরই একটি পথ রাজ্যে বিনিয়োগ টানিতে হইবে। শিল্প আসিলে এক দিকে কর্মসংস্থান হইবে, অন্য দিকে শিল্পের টানেই তরুণ প্রজন্ম পেশাদারি ভাবে যোগ্য হইয়া উঠিতে চেষ্টা করিবেন। বাজারের নিয়মেই সহায়ক প্রতিষ্ঠানও তৈরি হইবে। পশ্চিমবঙ্গের এই যে করুণ অবস্থা, তাহার দায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নহে। কিন্তু সমস্যাটি দূর করিবার দায়িত্ব নিশ্চিত ভাবেই তাঁহার। তিনি দায়িত্ব লউন। কিন্তু তাহার পূর্বে, সমস্যাটি স্বীকার করুন। সমস্যাটিকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব দিন। ‘আচার তৈরিও শিল্প, রবীন্দ্রনৃত্যও’ জাতীয় লঘু রসিকতা অনেক হইয়াছে খালি পেটে বেশি রসিকতা সহ্য হয় না। যে ‘শিল্প’ মানে বড় বিনিয়োগ, বিপুল কর্মসংস্থান, তিনি সেই শিল্পের সাধনা করুন। সিঙ্গুর হইতে টাটা মোটরস-এর বিদায়ের পাপ তাঁহার হাতে এখনও লাগিয়া আছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের আবাহন করিয়া প্রায়শ্চিত্ত করুন। রাজনীতির যূপকাষ্ঠে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে বলি দেওয়ার ভুল করিবেন না। |