পঠনপাঠনের পরিবেশ নষ্ট করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রায় প্রতিদিন যে ভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে, তা নিয়ে এ বার উদ্বেগ প্রকাশ করলেন স্বয়ং আচার্য তথা রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। রাজ্যপাল চান, পরিস্থিতির মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিক। এবং কী ব্যবস্থা নেওয়া হল, তা তাঁকে জানানো হোক।
বৃহস্পতিবার রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করেন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। পরে উপাচার্যই সাংবাদিকদের জানান, কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে সম্প্রতি যে সব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে চলেছে, তার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল। এই সব বন্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, তা জানতে চেয়েছেন তিনি। ব্যবস্থা নেওয়ার পরে সে বিষয়ে তাঁকে অবহিত করতেও বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রাজনৈতিক কাজিয়া বন্ধ করতে আচরণবিধি তৈরি করার কথা উপাচার্য জানিয়েছিলেন দু’দিন আগেই। এ দিন রাজ্যপালও নির্দিষ্ট পদক্ষেপ করার কথাই বললেন।
গত ২৭ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হেনস্থা হন প্রবীণ তৃণমূল বিধায়ক তথা বিধানসভায় সরকার পক্ষের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূলেরই অন্য গোষ্ঠীর সদস্যেরা তাঁকে মারধর করেন বলে অভিযোগ। এর প্রতিবাদে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের সামনেই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মিছিল করেছেন শোভনদেব-অনুগামীরা। কিছু দিন শিক্ষাকর্মীরা উপাচার্যকে ঘেরাও করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁদের অশালীন আচরণের বিরুদ্ধে থানায় নালিশ জানাতে বাধ্য হন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই প্রত্যেকটি ঘটনাই এ দিন রাজ্যপালের সঙ্গে উপাচার্যের আলোচনায় উঠে আসে। |
ক’দিন আগে উপাচার্য এমনও বলেছিলেন যে, ব্যক্তিগত ভাবে তিনি কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাস থেকে পঠনপাঠনের বিভাগগুলি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ারই পক্ষপাতী। কিন্তু এখনই তা সম্ভব নয়। তাই আপাতত ছাত্র ও শিক্ষাকর্মীদের জন্য তিনি আচরণবিধি তৈরি করছেন। সিন্ডিকেটের পরের বৈঠকে সেটা নিয়ে আলোচিত হবে। মঙ্গলবার উপাচার্য নিজেই এ কথা জানিয়ে বলেছিলেন, “কারও গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার জন্যও কিছু নিয়মবিধি মানতে হয়।”
উপাচার্যের কথার কোনও প্রভাব অবশ্য পড়েনি ক্যাম্পাসে। বৃহস্পতিবারই তারস্বরে মাইক বাজিয়ে ক্যাম্পাসের ভিতরে মিছিল করে এসইউসি-র ছাত্র সংগঠন ডিএসও। পরে ক্যাম্পাসের মূল ফটকের সামনে সমাবেশ করে তারা। ভিতরে তখন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করছিলেন, উপাচার্য-সহ অন্য কর্তারা। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, “ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে কখন, কী ভাবে আন্দোলন করবে, কর্তৃপক্ষ সেটা ঠিক করে দিতে পারেন না!”
এ দিন বেলা দু’টো নাগাদ কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর মূর্তির সামনে থেকে মিছিল করে ফের ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢোকেন ডিএসও সমর্থকেরা। উপাচার্যের প্রস্তাবের বিরোধিতায় প্ল্যাকার্ড হাতে মাইক বাজিয়ে নিজেদের বক্তব্য জানাতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। উপাচার্যের প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবিতে সুরঞ্জনবাবুর কাছে স্মারকলিপি দেয় ডিএসও-র প্রতিনিধি দল। বিজ্ঞান কংগ্রেসের বৈঠক থেকে মাঝপথে বেরিয়ে এসে স্মারকলিপি নেন উপাচার্য। পরে তিনি জানান, কোনও রকম চাপের কাছেই তিনি মাথা নোয়াবেন না। সুরঞ্জনবাবু বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে যে নিয়ম চালু করার কথা হয়েছে, সেগুলি সিন্ডিকেটে পেশ করা হবে। সিন্ডিকেট যা সিদ্ধান্ত নেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তা কার্যকর হবে।” তাঁর কথায়, “কারও গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ হচ্ছে না। কিন্তু শান্তিতে পড়াশোনা করা সব ছাত্রছাত্রীর গণতান্ত্রিক অধিকার। সেটা সুনিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নিতেই হবে।”
উপাচার্য চেয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যত্রতত্র পোস্টার সাঁটা বন্ধ হোক। কিন্তু কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে তার উল্টো ছবি। শাসক দলের বিভিন্ন সংগঠনও তাতে পিছিয়ে নেই। তৃণমূলের বিবদমান দুই কর্মী সংগঠনের পোস্টারের উপস্থিতিই বেশি। এর আগেও নিয়ম মেনে মিটিং-মিছিল, পোস্টার সাঁটার পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিন্ডিকেট। ফল হয়নি। এ বার ফের সেই সিদ্ধান্ত হলেই বা তা কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন উঠেছে। তবে উপাচার্যের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে এসএফআই। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের তরফে জানানো হয়েছে, কর্তৃপক্ষ কী সিদ্ধান্ত নেন দেখে প্রতিক্রিয়া জানাবে তারা। |