|
|
|
|
বাবা জ্ঞান দিয়োনা |
অপুর পাঁচালি |
প্রায় ষাট বছর বাদে সত্যজিৎ রায়ের অপু ফিরে গেলেন নিশ্চিন্দিপুরে। সঙ্গে ছিলেন ইন্দ্রনীল রায় |
“পুকুরটা দেখেছেন, ওটাতেই কিন্তু সেই পুঁতির মালাটা ফেলেছিলাম।”
“দরজার পাশের এই দেওয়ালটা শ্যুটিংয়ের সময় ভাঙা ছিল। কত বার টপকে গেছি ভাঙা দেওয়ালটাকে।”
“আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানেই লাস্ট সিনে সাপটা শ্যুট করেছিলেন কাকাবাবু।”
“জানেন, এই জবা গাছটা কাকাবাবু লাগিয়েছিলেন। ওখানে ইন্দির ঠাকরুন এসে জল ঢালতেন খাওয়ার পর।”
উপরের উক্তিগুলো যাঁর, তাঁর বয়েস এখন ৬৭। ভি আর এস নিয়েছেন বার্ড অ্যান্ড কোম্পানি থেকে বেশ কয়েক বছর হল।
ম্যুর অ্যাভিনিউয়ের ওয়্যারলেস পার্কের কাছে তাঁর বাড়ি থেকেও ট্রেন লাইন দেখা যায়, কিন্তু সেটা মেট্রোর।
আর প্রত্যেক বছর ২৬ অগস্ট, যে দিন ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পেয়েছিল সেই দিনটায় দিদি দুর্গার সঙ্গে দেখা করতে ভীষণ মন ছটফট করে তাঁর।
সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘পথের পাঁচালী’র অপু।
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সুবীরবাবুর জীবন অবলম্বনেই শুরু করতে চলেছেন তাঁর পরের ছবি, যাঁর ওয়ার্কিং টাইটেল ‘অপু’।
শ্যুটিং শুরু হবে ফেব্রুয়ারি মাসে। সেই অপুকে নিয়েই রবিবারের সকালে বোড়ালে ‘পথের পাঁচালী’র শ্যুটিং স্পটে গিয়েছিল ‘আনন্দ প্লাস’। সঙ্গে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। |
|
নামলেই যেন কাকাবাবুকে দেখতে পাই
গড়িয়া মোড় থেকে দশ মিনিটের রাস্তা। তার মধ্যেই আপনি পৌঁছে যাবেন বোড়াল, যেখানে ‘পথের পাঁচালী’র শ্যুটিং করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। গাড়ি পার্ক করলেই দেখতে পাবেন লোকনাথ কেটারারের বোর্ড, মানিকবাবুর একটা হতশ্রী আবক্ষমূর্তি।
অলস রবিবারের সকাল।
তার মধ্যেই গাড়ি থেকে নামলেন সুবীরবাবু।
“আপনারা সিগারেট খান?”, গাড়ি থেকে নেমেই প্রশ্ন তাঁর। “একটা ধরাই তা হলে। আসলে এই বাড়িটার সামনে এলেই কাকাবাবুকে দেখতে পাই, আমি!” উদাস দৃষ্টিতে বাড়িটা দেখতে দেখতে নিজের মনেই বলেন সুবীরবাবু। সত্যজিৎ রায়কে যে আজও কাকাবাবু বলেই ডাকেন তিনি।
তাঁর কাছ থেকেই শোনা গেল, ১৯৫২ সালে প্রথম এসেছিলেন এই বাড়িটায়। তার পর প্রায় আড়াই বছর নানা খেপে বহু বার এসেছেন তিনি। “কিন্তু প্রত্যেক বার আসলেই মনে হয়, এখনই শ্যুটিং শুরু হবে। দেখতে পাই বংশীবাবুকে (বংশী চন্দ্রগুপ্ত), দেখতে পাই মাকে, দেখতে পাই মাস্টারমশাই তুলসীবাবুকে (তুলসী চক্রবর্তী), দেখতে পাই দিদিকে।”
দিদি মানে উমা দাশগুপ্ত, ‘পথের পাঁচালী’-তে দুর্গার ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছিলেন। “আজকাল তো দিদি আর বেরোতেও চায় না। শরীর ভাল থাকে না শুনেছি। দেখা সাক্ষাৎও কম হয়।”
৫৭ বছর হয়ে গিয়েছে ‘পথের পাঁচালী’র মুক্তি পাওয়ার, কিন্তু সুবীরবাবু যেন আজও অপু।
ছোটবেলায় শুধু সিনেমায় অপুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
কে জানত সারা জীবন বহন করতে হবে সেই অপুকে। |
কিছু চরিত্র কিছু অভিনেতাকে কোনও দিন ছাড়ে না। সুবীরবাবুকে আজও ছাড়েনি অপু
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় |
|
অপু আমায় ছাড়বে না “কিছু চরিত্র কিছু অভিনেতাকে কোনও দিন ছাড়ে না। সুবীরবাবুকে যেমন আজও ছাড়েনি অপু। সেই ভাবনা থেকেই আমার এই ছবিটা প্ল্যান করা। সাম সিনেমা নেভার লিভস ইউ। আর সুবীরবাবুর জীবনটা সিনেমাটিক্যালি ভীষণ ইন্টারেস্টিং! এর আগে চপল ভাদুড়ির জীবন অবলম্বনে বানিয়েছিলাম ‘আর একটি প্রেমের গল্প’। তার পর ‘অপু’।” ‘পথের পাঁচালী’র বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।
কৌশিক ভুল বলেননি। সুবীরবাবুর জীবন কিন্তু সত্যিই ইন্টারেস্টিং। অপুর জীবনের সঙ্গে কাকতালীয় ভাবে সুবীরবাবুর জীবনেরও। সেটাই ছবির মূল বিষয়বস্তু। “১৯৫৫ সাল থেকে অপু হয়ে গেলাম জানেন। যেখানেই যাই, আমাকে বলা হত, ‘পথের পাঁচালী’র অপু। স্কুল, কলেজ, অফিস, সব জায়গাতেই অপু। মাঝে মাঝে বিরক্তও হতাম, কিন্তু পরে বুঝেছি অপু আমায় ছাড়বে না।” আসতে আসতে বলেন তিনি।
ছাড়েনি তো সত্যি। আজও এত বছর পর তাঁকে নিয়ে দেশ বিদেশের সিনেমাপ্রেমিকদের কৌতূহলের শেষ নেই। “ কী আর করেছি বলুন আজও কত লোক আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে। সব তো অপুর জন্য,” বলেন সুবীরবাবু। গলায় অপুর প্রতি এক হতাশ ভালবাসা মিশ্রিত পিছুটান। |
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
দেখেছেন তুলসীতলাটা এক রয়ে গেছে...
বোড়াল পৌঁছে তাঁর সঙ্গে নানা কথা বলতে গিয়ে খালি মনে হচ্ছিল অপু নয়, আসলে কথা বলছি, ‘সোনার কেল্লা’র মুকুলের সঙ্গে!
জাতিস্মরের মতোই যেন সব মনে পড়ে যাচ্ছে সুবীরবাবুর।
“পুঁতির মালা ফেলার যেদিন শ্যুটিং হয়েছিল, সকাল থেকে খুব বৃষ্টি! আমি তো ভেবেছিলাম আজ আর শ্যুটিং হবেই না। তার পর একটু বৃষ্টি থামতেই শটটা হয়ে গেল,” উদার কণ্ঠে বলে চলেন সুবীরবাবু।
তার পরেই আমাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু ধমক। “আপনারা ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? বাড়ির ভিতরে চলুন। দেখুন, গেটটা একেবারে এক আছে। ও মা, তুলসীতলাটা রয়ে গেছে, দেখেছেন! এর আশেপাশে কত আড্ডা হত।” বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত তুলসীতলার পাশে তখন মগ্ন অপু।
কিছুটা আমরাও। |
এখন |
তখন |
|
|
দুর্গার মৃত্যুর দৃশ্যে এই জানলা দিয়েই চটের পর্দা উড়তে দেখা গিয়েছিল |
|
তেনু ম্যাঁয় লাভ করদা
এর মধ্যেই বাড়ির আজকের বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথবাবু এলেন দেখা করতে। জানালেন, আজকাল আর বিশেষ কেউ আসে না। দেখালেন কোন ঘরটা সিনেমায় ইন্দির ঠাকরুনের ঘর ছিল। দেখালেন কোন সিঁড়িতে বসে দুর্গার চুল বেঁধে দিতেন সর্বজয়া। এর মধ্যেই আমাদের নিয়ে গেলেন হরিহরের বাড়িতে। সেটা আজকে কংক্রিটের একতলা বাড়ি। ঠিক তার উল্টো দিকে, ইন্দির ঠাকরুনের যে বাড়িটা সিনেমায় দেখানো হয়েছিল সেটা এখন দোতালার ইটের বাড়ি। যদিও ছাদ আজও টালির।
অপুর সামনে তখন সেই বারান্দাটা।
দুর্গার মৃত্যুর আভাস সর্বজয়া যেখানে হরিহরকে দিয়েছিলেন, সেই উঠোনটা দেখে তখন চোখ ছলছল দুর্গার ভাইয়ের। “এত বার দেখেছি ছবিটা, কিন্তু সিনটার সঙ্গে তারসানাইটা শুনলে আজও কেঁদে ফেলি”, ফিসফিস করে পাশ থেকে বলেন কৌশিক।
বাড়ির বাইরে তখন পাড়ার ছেলেদের ক্রিকেট খেলা চলছে।
তাঁদের কারও মোবাইলের রেডিওতে বাজছে মিকার গান, ‘তেনু ম্যাঁয় লভ করদা’। |
|
ওই জানলাটা দেখছেন...
এর মধ্যেই ঢুকলাম সেই ঘরটায়, যেখানে দুর্গার মৃত্যুদৃশ্যটা শ্যুট করা হয়েছিল।
সেটার বাইরে আজকে প্লাস্টিক-এর মিকি মাউসের স্টিকার।
ঢুকেই সুবীরবাবু দেখালেন সেই তাকটা। “এই তাকটা থেকেই সেই পুঁতির মালাটা পেয়েছিলাম। আর ওই জানলাটা দেখছেন, ওই জানলাটাই দেখানো হয়েছিল দিদির মৃত্যুর দৃশ্যে। তখন এখানে খাটটা ছিল। মা এ দিকটায় বসেছিলেন। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে ক্যামেরা নিয়ে শ্যুট করেছিলেন কাকাবাবু। আর যে পর্দা উড়ছে দেখানো হয়েছিল, সেগুলো আসলে ছিল চটের,” ঘরের বাকিদের উদ্দেশে ধরা গলায় বললেন তিনি।
বুঝতে অসুবিধে হয় না, দুর্গার মৃত্যু আজও অপুকে কতটা নাড়ায়। “সুবীরবাবু, চলুন এ বার বেরোই,” ধীর গলায় বললেন কৌশিক। “হ্যাঁ চলো, কী রকম লাগে এই ঘরটায় এলে,” বলতে বলতে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
বেরোনোর আগে তুলসীতলার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন। আমাদের দেখালেন কোন দিকটায় খাটাল ছিল। বললেন, ‘একটু বাঁশবনে যাবেন? বাঁশবন ছাড়া ‘পথের পাঁচালী’ হবে না কিন্তু,”, বলতে বলতে বাঁশবনের দিকে এগিয়ে গেলেন বাংলা সিনেমার অন্যতম সেরা চরিত্র।
পাড়ার লোকেরা মৃদু বারণ করলেন, “একটু সাবধানে যাবেন। ও দিকটায় সাপটাপ...” কিন্তু কে শোনে কার কথা। সুবীরবাবু তখন ‘অপু’। দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ‘নিশ্চিন্দিপুর’। গাড়ি স্টার্ট হওয়ার সঙ্গেই আবার কাচ নামান তিনি।
‘‘একটা জিনিস বলতেই ভুলে গিয়েছি। জানেন, আজও কাশফুল দেখলে দিদির কথা ভীষণ মনে পড়ে। কিছুতেই ভুলতে পারি না সেই রেল গাড়িটা, কিছুতেই ভুলতে পারি না সেই সময়টা” বলে গাড়ির কাচ তুলে ‘নিশ্চিন্দিপুর’ ছেড়ে চলে যান ‘পথের পাঁচালী’র অপু।
ফিরে যান তাঁর মধাবিত্ত অপু-সর্বস্ব জীবনে।
|
এখন |
তখন |
|
|
১) গোয়াল নেই ২) জবা ফুলের গাছ যা সত্যজিৎ রায়
নিজে পুঁতেছিলেন ৩) তুলসীতলা ৪) কংক্রিটের বারান্দা,
দেওয়ালে মিকি মাউস ৫) পাকা ঘর কিন্তু কড়িকাঠগুলো
সেই আগের ৬) ইন্দির ঠাকরুনের ঘর যা আজ দোতলা বাড়ি |
১) গোয়াল ২) জবা ফুলের গাছ যা সত্যজিৎ রায়
নিজে পুঁতেছিলেন ৩) তুলসীতলা ৪) যে বারান্দায়
সর্বজয়া হরিহরকে দুর্গার মৃত্যুর খবর শুনিয়েছিল
৫) যে ঘরে দুর্গার মৃত্যু হয় ৬) ইন্দির ঠাকরুনের ঘর |
|
|
|
|
|
|