মালতী ও একটি বাঘ
ঠাৎই হাম্বা ডেকে উঠল মালতী। একবাড়ি লোকের সামনে। এ হেন অশিক্ষিত আচরণের ফলে উকিলবাবু গেলেন খেপে। ইতিপূর্বে তিনি বিহেবিয়ারাল অ্যাসপেক্টের ওপর মালতীর অনেক ক্লাস নিয়েছেন। ভদ্র সমাজে মেলামেশা, মেপে ডাক ছাড়া। তবুও ভুল সে করবেই। এ রকম অপদার্থতার ক্ষমা হয় না। রেগেমেগে উকিলবাবু তাড়িয়ে ছাড়লেন মালতীকে। দূর হ হতভাগী, গরু কোথাকার, মাথায় গোবর, শেখালেও শেখে না...। অগত্যা গোয়ালঘর ছাড়তে হল মালতীকে।
অথচ এ ব্যাপারে মালতীর দোষ ছিল না। জাতিতে সে বিশুদ্ধ গরু। তার চারটি পা, দু’টি শিং, একটি লেজ এবং মাতৃভাষা হাম্বা। উকিলবাবুর বাড়িতে সে খড় খেত, দুধ দিত। মাঝেসাঝে উপরিও জুটত, পাঁচনের ঘা।
বিতারিত হওয়ার পর মালতী পড়ল বেশ ফাঁপরে। একে গরু তার ওপর মাথামোটা। এ অবস্থায় অন্য কোথাও ঠাঁই হওয়াও মুশকিল। হলেও ক’দিন টিকবে সন্দেহ।
অনেক ভেবে মালতী ঠিক করল সে তার পুরনো গ্রামে ফিরে যাবে। সেখানে এখনও দু’বেলা দু’মুঠো ঘাসপাতা পাওয়া যায়। শহরে এ সব জোগাড় করা কঠিন। তার ওপর গ্রাম অনেক ছিমছাম এবং ঝুটঝামেলাহীন। আন্তরিকতাও বেশি, ঘরে বাইরে প্রাণ খুলে হাম্বা ডাকা যায়।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। মালতী চলে এল নিজের গ্রামে, যেখানে তার বাছুরবেলা কেটেছে। গ্রামটি ভারী সুন্দর। এক পাশে ছোট তিরতিরে নদী, অন্য পাশে গভীর জঙ্গল। মালতী জঙ্গলের দিকে চরে। তেষ্টা পেলে নদীর জল পান করে। দু’দিকেই লোকজন কম। গাঁয়ের
লোকেরা বলে একা একা ঘুরিসনি, সব সময় গ্রুপে থাকবি।
ছবি: সুমিত্র বসাক
মালতী অবাক হয়। সব কিছুই আগের মতো আছে। অথচ সমস্ত গ্রামে একটা থমথমে ভাব। চার দিকে ঘুরঘুর করছে অশনি। তবুও কারও মুখে কথা নেই।
এই সব সাতসতেরো ভাবতে ভাবতে মালতী সে দিন ঘাস চিবচ্ছিল জঙ্গলের ধারে। হঠাৎ একটা হালুম আওয়াজ। একেবারে তার মাথার গোড়ায়। মাথা তুলে সে দেখল প্রমাণ সাইজের এক বাঘ। চোখ দুটো জ্বলছে, জিভ দিয়ে লালা ঝরছে টপটপ করে। গোঁফগুলো নেচে নেচে বলছে, ‘এ বার বাছা তোমায় খাব’। বাঘব্যাটাকে দেখেই মালতী বুঝল সবার ভয়ের কারণটা। সে আরও বুঝল উৎপাতটা নতুন আমদানি। ভয় পেলে চলবে না। শহুরে কায়দায় হেসে জিজ্ঞেস করল, হ্যালো মিস্টার, হাউ ডু ইউ ডু? মালতীর মুখের ইংরেজি আর চোখে ভয় না দেখে বাঘবাহাদুর গেল বমকে। তার ইংরেজির দৌড় টু পর্যন্ত। সে গলাটা যথাসম্ভব ভারী করে জিজ্ঞেস করল, এই গরু তুমি জানো আমি কে? আমি এখন এই জঙ্গলের মালিক, আমাকে সবাই ভয় পায়। আর তুমি আমার সামনে ইংরেজি কপচাচ্ছ! মালতী বলল, ডোন্ট বি অ্যাংরি, রক্তচাপ বেড়ে যাবে। হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে। মালতীর মতো সামান্য এক গরুর মুখে এ রকম উপদেশ শুনে বাঘের রাগ গেল আর এক ঘর উস্কে। সে বলল, আবার ইংরেজি, কথা না শুনলে এ বার এক হাঁয়েতেই হাওয়া করে দেব। মালতী হাসল। বলল তা তুমি পার। এক গ্রাসে গপ করে গিলে ফেলতে, কিন্তু হজম হবে না। এতে বাঘ গেল আরও রেগে। বলল দাঁড়া দেখাচ্ছি তোর মজা। এই বলে সোজা লাফিয়ে পড়তে গেল মালতীর ওপর।
মালতী শিং নাচিয়ে ক্ষান্ত করল তাকে। বলল এ ভাবে নয়, তা হলে মজাটা আমি নিজে দেখতে পাব না। তুমি আমায় পরে খাবে। তার চেয়ে এখন বরং আমি যা খাই তাই খেয়ে দেখাও। যদি পেটে সয় মেনে নেব আমাকে হজম করতে পারবে। না হলে পিঠে খাবে শিং-এর গুঁতো। মালতীর কথা শুনে বাঘটা থ। দাঁড়িয়ে রইল হাঁ করে। মালতী অবজ্ঞা ভরে বলল, জানতাম পারবে না। বাঘটা তখন বেইজ্জত। সম্মান বাঁচাতে হুড়মুড়িয়ে খেতে শুরু করল ঘাস। সে আগে কখনও বস্তুটা টেস্ট করেনি। তেঁতো, বিদঘুটে এক রাশ ঘাস জোর করে খেয়ে তার পেট গুলিয়ে উঠল এবং সে হড়হড় করে বমি করে ফেলল।
মালতী আনন্দে লাফিয়ে উঠল, দেখলে আমার কথাই ঠিক, তুমি আমার এই শরীরটা খেয়ে কখনওই তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারবে না। বমি করে মরবে। মালতীর কথা শুনে একেবারে কুঁকড়ে গেল বাঘটা। সে ভাবল এ নিশ্চয় স্বয়ং গোমাতা। সে মালতীর চার পায়ে সঁপে দিল নিজেকে। আশ্রয় নিল তার লেজের নীচে।
কথায় বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। উকিলবাবু সে দিন এসেছিলেন চুপিচুপি বাঘের ছবি তুলতে। গোলেমালে পেয়ে গেলেন আরও বেশি কিছু। বাঘ মাংসাশী সবাই জানে, কিন্তু সে যে ঘাসও খায় সে খবর কেউ রাখে না। উকিলবাবুর ক্যামেরায় এখন এমনই একটা দুর্লভ ছবি। তাও মালতীর বদান্যতায়। এ যেন ভাবাই যায় না। সে দিনের ব্যবহারের জন্য মনে মনে তিনি দুঃখিত। মালতীকে বললেন, ফিরে চল।
মালতীর অভিমান হয়েছিল। সে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। তার পায়ের কাছে বাঘটাও, বাছুরের মতো। উকিলবাবু খুশি। এ ছবিও কম দুর্লভ নয়। খুশি গ্রামের মানুষও। তাদের মালতী পোষ মানিয়েছে হিংস্র বাঘকে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.