কলকাতা ও জেলার নাট্যদলগুলিকে এক ছাতার নীচে আনতে উদ্যোগী হলেন শাসক দলের ঘনিষ্ঠ নাট্যকর্মীদের একাংশ।
শনিবার মৌলালি যুব কেন্দ্রে নাট্যস্বজন নামে একটি সংগঠনের তরফে এই ডাক দেন নাট্যকার-অভিনেতা তথা শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তবে তাঁর আহ্বান, “সিপিএমের সদস্যরাও নিঃসঙ্কোচে এই ছাতার নীচে আসতে পারেন। এখানে আমরা সবাই এক সঙ্গে শুধু থিয়েটারের প্রসারে কাজ করব।”
কলকাতার প্রথম সারির নাট্যব্যক্তিত্বদের মধ্যে কেউ কেউ এই প্রয়াসের ‘অরাজনৈতিক’ চরিত্র নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। তাঁদের কেউ কেউ একে কলকাতা ও মফস্সলের নাট্যদলগুলিকে সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বলেও সন্দেহ করছেন।
কৌশিক সেন যেমন বলছেন, “বাম জমানায় শাসক দল প্রভাব খাটিয়ে কয়েকটি দলের সুবিধা করে দিত। আর পরিবর্তনের পরে পরিশীলিত ঢঙে অন্য একটি সংগঠনের (নাট্যস্বজন) নাম করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু হয়ে গেল।” নাট্যস্বজন-এর অরাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে অবিশ্বাসের কারণ হিসেবে মাস দুয়েক আগে এই সংগঠনের জন্মলগ্নের একটি ঘটনার দিকে আঙুল তুলেছেন কোনও কোনও নাট্যকর্মী। সুমন মুখোপাধ্যায় বা সংগ্রাম গুহ মনে করিয়ে দিয়েছেন, অভিনেতা বিমল চক্রবর্তী শাসক দলের কিছু কর্মী-সমর্থকের হাতে ‘হেনস্থা’ হওয়ার পরে প্রতিবাদ সভা করা হলে নাট্যস্বজন তার পাল্টা সভা করে। সেই সভা পুরোপুরি তৃণমূলের রাজনৈতিক সভা হয়ে উঠেছিল। সংগ্রাম বলেন, “শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু স্বয়ং যখন সংগঠনের মাথা, তখন তাকে কী ভাবে অরাজনৈতিক বলা যাবে!” ব্রাত্যর পাল্টা জবাব, “আমি নাট্যকর্মী বলেই বিধায়ক বা মন্ত্রী হয়েছি। আর এখন নাটকের ব্যাপারে থাকতে পারব না, তা কী করে হয়!”
বিমল চক্রবর্তীর ঘটনার পরে নাট্যস্বজনের সভাতেই ব্রাত্য বলেছিলেন, ‘তুমি সিপিএমত্ব দেখালে, আমি তৃণমূলত্ব দেখাব’। এমন মন্তব্যের পরে ব্রাত্য সিপিএম সদস্যদের ওই সংগঠনে আহ্বান জানালেও তা নিছক ‘ফাঁকা আড়ম্বর’ বলে খারিজ করে দেন কৌশিক। ব্রাত্য অবশ্য এ দিন বোঝাতে চেয়েছেন যে, তাঁর মন্তব্যের অপব্যাখ্যা হয়েছে। তিনি বলেন, “বলেছিলাম, কেউ আমার কাছে শিল্পী হয়ে এলে, আমি শিল্পী। কেউ সিপিএমত্ব দেখালে আমিও তৃণমূলত্ব দেখাব।” |
নাট্যস্বজনের সভাপতি ব্রাত্য এবং দুই সম্পাদক অর্পিতা ঘোষ ও দেবেশ চট্টোপাধ্যায়দের বক্তব্য, বিমলবাবুর পাশে দাঁড়াতে যাঁরা সভা করেছিলেন, তাঁরা আসলে বাম-সমর্থক। রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেই মাঠে নেমেছিলেন। একদা পরিবর্তন-পন্থী বলে চিহ্নিত কৌশিকের বক্তব্য, সেটা সত্যি। কিন্তু এই নতুন গোষ্ঠীও তো অন্য শিবিরের। নাট্যকর্মী হিসেবে ব্রাত্য-অর্পিতা-দেবেশদের শ্রদ্ধা করেন বলে জানিয়েও কৌশিক বলেন, “আমার দল কোনও শিবিরেই থাকবে না।”
নাট্যস্বজন-এর গায়ে এই ‘তৃণমূলী’-ছাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে বলে অবশ্য মঞ্চ থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আহ্বায়কেরা। বালুরঘাট থেকে বারাসত থেকে শ’দেড়েক নাট্যকর্মী এ দিন কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁদের সামনে দেবেশ বলেন, “এই সংগঠন তৃণমূলের সাংস্কৃতিক ইউনিট হলে আমি এতে নেই!” অর্পিতা বলেন, “আমি সরকারের অন্য অনেক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি, কিন্তু এই সংগঠন অরাজনৈতিক। এখানে আমরা কোনও রং দেখব না।” বাম-জমানায় শাসক দলের তরফে অর্পিতা, ব্রাত্য বা কৌশিকের নাটকের অভিনয়ে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। এই জমানায় কী ঘটবে? ব্রাত্য-অর্পিতাদের প্রশ্ন করা হলে তাঁরা অবশ্য বলেন, “কে কোন বিষয় নিয়ে নাটক করছে, তা নিয়ে নাট্যস্বজন মাথা ঘামাবে না।”
ঠিক কী ভাবে কাজ করবে এই সংগঠন? উদ্যোক্তারা জেলা ও শহরের মধ্যে সেতু বন্ধনের কথা বলেন। মফস্সলের নাটককে কলকাতার আরও কাছে আনা হবে। কলকাতাও গ্রামে যাবে। জেলার দলগুলির সম্পূর্ণ নথি তৈরি করতে নাট্য আকাদেমিকে সাহায্য করবে নাট্যস্বজন। নাট্যাভিনয়-সংক্রান্ত হল কমিটির কর্ত্রী অর্পিতাকে মঞ্চ থেকেই ব্রাত্য বলেন, “জেলার দলগুলোকে কলকাতায় বেশি করে অভিনয়ের সুযোগ দিন। শনি-রবিবারেও।” হাততালির রোল ওঠে। তিনি জেলায় জেলায় সম্মেলন করার কথাও বলেন। কলকাতার বিশিষ্ট নাট্যকর্মীদের একাংশের মধ্যে এই ধরনের সংগঠন নিয়ে কিছুটা দ্বিধার সুর। মমতা-শিবিরের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বিভাস চক্রবর্তী বলেন, “আমাদের দল কখনও এমন ছাতা-সংগঠনের মধ্যে থাকেনি। বিষয়টা নিজেদের মধ্যে আলোচনা-সাপেক্ষ।” সুমন কিছুটা আহত বন্ধু ব্রাত্য-অর্পিতা-দেবেশদের কাছ থেকে সভায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ না-আসায়। তিনি বলেন, “দেখা যাক, কী হয়! যা দেখেছি, রাজনৈতিক রং তো সবেতেই লেগে যায়!” |