জুটছিল না মাত্র একশো একর জমি। আর সে জন্য রাজ্যের হাত থেকে যেতে বসেছিল ‘সিনক্রোট্রন’ নামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রটি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আশ্বাস মিলেছে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে। আর তার জোরে কর্নাটকের সঙ্গে পাঞ্জা কষে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি রেখে দিতে পারছে পশ্চিমবঙ্গ। প্রকল্পটি শেষ হলে তা হবে বিশ্বের পঞ্চম এমন গবেষণা কেন্দ্র। গবেষকদের কথায়, বিশ্বের সেরাও বটে।
ভারতে প্রথম এই পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র গড়ার বরাত পাচ্ছে কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (এসআইএনপি)। সংশ্লিষ্ট গবেষক এবং বিজ্ঞানীদের দাবি, এটি রূপায়িত হলে নতুন ওষুধ আবিষ্কার থেকে রসায়ন, জৈবপ্রযুক্তি বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। উপকৃত হবেন দেশের, বিশেষ করে রাজ্যের বিজ্ঞানী। শিল্পমহলও।
অথচ, সামান্য জমির জন্য ঝুলেছিল এই প্রকল্পের ভাগ্য। সাহা ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর মিলনকুমার সান্যাল জানাচ্ছেন, প্রাথমিক ভাবে জমি দিতে রাজি ছিল না রাজ্য সরকার। সংস্থার পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও জট কাটছিল না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে প্রকল্পটি ছিনিয়ে নিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)। ওই সংস্থার পক্ষ থেকে কেন্দ্রকে জানানো হয়, দক্ষিণ কর্নাটকের চিত্রদুর্গ জেলায় যথেষ্ট জমি আছে। সেখানে স্বচ্ছন্দে প্রকল্পটি গড়তে পারে তারা। কেন্দ্র যখন আইআইএসসি-কে বরাত দেওয়ার ব্যাপারে মনস্থ করে ফেলেছে, তখন নড়েচড়ে বসে মহাকরণ। রাজ্যের তরফে সাহা ইনস্টিটিউটকে সম্প্রতি বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-সহ তিন-চারটি জায়গার কথা জানিয়ে বলা হয়েছে, আপনারা এসে জায়গা পছন্দ করুন।
কী এই সিনক্রোট্রন? এর ব্যবহারিক দিকগুলিই বা কী?
এটি এক ধরনের ‘সাইক্লিক পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটর’। অর্থাৎ, এই যন্ত্রের সাহায্যে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইলেকট্রনের মতো পরমাণুর মধ্যেকার ক্ষুদ্র কণাকে ঘুরিয়ে প্রবল শক্তি তৈরি করা সম্ভব হয়। তার ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তা পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা এবং জৈব-রসায়নের বিভিন্ন শাখায় অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা নেয়। সাহা ইনস্টিটিউটের গবেষক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “এত দিন নমুনা নিয়ে বিদেশে যেতে হত। অন্যান্য দেশের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করতে হত। এ বার হাতের কাছেই যন্ত্রটি থাকায় গবেষণার গতি নিঃসন্দেহে অনেক গুণ বেড়ে যাবে।” |
বিশ্বের মাত্র চারটি দেশে রয়েছে সিনক্রোট্রন। “জাপান, আমেরিকা, ফ্রান্স এবং জার্মানি। প্রযুক্তিগত ভাবে এ রাজ্যেরটিই সেরা হতে চলেছে,” জানাচ্ছেন সাহা ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর মিলনবাবু। কী কী কাজে লাগতে পারে এই সিনক্রোট্রন, সে সম্পর্কে গবেষকরা জানাচ্ছেন
• ক্যানসারের চিকিৎসা
• নতুন ওষুধ আবিষ্কার এবং গবেষণা
• বিভিন্ন খনিজ পদার্থ বিশ্লেষণ করে তার থেকে মূল উপাদানগুলি বের করা
• জল ও বায়ুদূষণ করে যে সব পদার্থ, তাদের পরিমাণ ও উৎস নির্ধারণ
• জিওলজিক্যাল মেটিরিয়াল অ্যানালিসিস, অর্থাৎ ভূতাত্ত্বিক পদার্থের পরীক্ষা-নিরীক্ষা
• মেডিক্যাল ইমেজিং, অর্থাৎ চিকিৎসার জন্য ছবি তোলা
• প্রোটিন অণুর ছবি তোলা এমন অনেক ক্ষেত্রেই আপাতত সিনক্রোট্রনই শেষ কথা।
ভারতে সিনক্রোট্রন বসিয়ে তার সুফল লাভ করা যে সম্ভব, এই চিন্তা প্রথম এসেছিল মিলনবাবুর মাথাতেই। গত বছর অগস্টে বিষয়টির প্রয়োজনীয়তার কথা বিশদে উল্লেখ করে তিনি একটি চিঠি পাঠান যোজনা কমিশনে। এই নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আলোচনা হয় তাঁর। কয়েক দফা আলোচনার পর যোজনা কমিশন জানায়, প্রকল্পটি অনন্য। তার গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে তাঁরা রাজি।
যে হেতু গোড়া থেকেই এই প্রকল্প গড়ার প্রশ্নে সাহা ইনস্টিটিউট যুক্ত, তাই অগ্রাধিকার তাদেরই দেওয়া হয়। “কিন্তু এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় একশো একর জমি পেতে খুবই সমস্যা হচ্ছিল,” জানাচ্ছেন মিলনবাবু। মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে একাধিকবার চিঠি লিখেও কাজ হয়নি। প্রাথমিক ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর অফিস থেকে জানানো হয়, এই জমি দেওয়া সম্ভব নয়। নতুন করে জমি অধিগ্রহণের জটিলতায় এখন যেতে চায় না সরকার। পুরনো যে জমি রয়েছে, তা রেখে দেওয়া হয়েছে এইমস হাসপাতাল, ট্রিপল আইটি-র মতো সংস্থা গড়ার জন্য। হতোদ্যম না হয়ে সংস্থার পক্ষ থেকে এর পর যোগাযোগ করা হয় তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের সঙ্গে। তিনিও চেষ্টা করতে থাকেন, যাতে প্রকল্পটি রাজ্যের হাতছাড়া না হয়। এই অবস্থায় দীর্ঘসূত্রতার গন্ধ পেয়ে বেঙ্গালুরুর আইআইএসসি যোজনা কমিশনকে চিঠি লিখে জানায়, তারা জমি নিয়ে বসে রয়েছে।
প্রকল্পটি যখন প্রায় হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে যোগাযোগ করা হয় সাহা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। বলা হয়, কয়েকটি জেলায় সরকারের নিজস্ব বেশ কিছু পুরনো জমি রয়েছে। নতুন করে অধিগ্রহণের প্রয়োজন নেই। সেই জমিতেই প্রয়োজনীয় প্রকল্পটি শুরু করা যেতে পারে। মমতা নিজেও জানিয়েছেন, এই প্রকল্প যাতে রাজ্যে থাকে, সে জন্য তিনি আগ্রহী।
রাজনৈতিক কারবারিদের বক্তব্য, ক্ষমতায় আসার দেড় বছর পরেও কেন কর্মসংস্থান হচ্ছে না, শিল্প ও গবেষণাক্ষেত্রে কেন কিছু হচ্ছে না ক্রমাগত এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে মমতাকে। লগ্নিকারীদেরও আস্থা কমছে। এই পরিস্থিতিতে জমি নিয়ে নিজের নীতিতে অনড় থেকেও নেতিবাচক ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। বিভিন্ন জেলায় গিয়ে যে সব প্রকল্পের শিলান্যাস তিনি করে এসেছেন, সেগুলির বর্তমান অবস্থান সংক্রান্ত রিপোর্টও তিনি জরুরি ভিত্তিতে চেয়ে পাঠিয়েছেন অফিসারদের কাছে। অর্থাভাব এবং জমি নীতি নিয়ে জটিলতার মধ্যেও আসন্ন পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটের আগে ‘ঘুরে দাঁড়াতে’ চাইছে রাজ্য সরকার। আর এই পরিস্থিতিরই সুফল পেতে চলেছে সিনক্রোট্রন প্রকল্প! |