পুস্তক পরিচয় ১...
ইতিহাসও এক নির্মাণ মাত্র
বাঙালির ইতিহাসচিন্তা,
সম্পা: রত্না ঘোষ, প্রণব বর্মণ। ভট্টর কলেজ, দাঁতন, ২০০.০০
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় স্মারকগ্রন্থ,
সম্পা: সমীর পাত্র, শেখর ভৌমিক। মহিষাদল রাজকলেজ, ১৮০.০০
ইতিহাস ও সাহিত্য: প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার,
সম্পা: সমীর পাত্র, অরিন্দম চক্রবর্তী। তমলুক ইতিহাসচর্চা কেন্দ্র/ আশাদীপ, ১০০.০০ পরিবেশক: দে’জ
নিশ শতকের শেষ দশক থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় প্রাথমিক উচ্ছ্বাস পেরিয়ে ইতিহাসচর্চা অনেক বেশি প্রমাণ-নির্ভর হয়ে উঠল। বিতর্ক চলেছিল স্বদেশি ও পাশ্চাত্য ইতিহাস প্রকরণে। বিরোধ বেধেছিল ইতিহাসের প্রমাণ-নির্ভর সত্যের সঙ্গে জীবন-নির্ভর সাহিত্য ও শিল্পের মহাসত্যের। এই চিন্তা আন্দোলন ও বিতর্কের আধার সে সময়ের পত্রপত্রিকাগুলি এখন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এই অপস্রিয়মাণ স্মৃতি-ভাণ্ডার রক্ষার নাগরিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি কলকাতা থেকে অনেক দূরে দাঁতন, মহিষাদল বা তমলুকের গবেষকদের চর্চার পরিচয় বহন করছে আলোচ্য বই তিনটি।
বাঙালির ইতিহাসচিন্তা-য় ১৮৯৩-১৯৫১-র মধ্যে প্রকাশিত রজনীকান্ত গুপ্ত, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, যদুনাথ সরকারের সঙ্গে অক্ষয়কুমার সেন, সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের মতো বারো জন লেখকের ইতিহাস চিন্তা ধরা রয়েছে। ভূমিকায় লেখক পরিচিতি উপরি পাওনা। এই সব রচনায় অল্পবিস্তর পাশ্চাত্য ইতিহাসের ধারণার জয় ঘোষিত হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার তো পাশ্চাত্য ইতিহাসবিদ্যার নিরিখে দেশীয় ইতিহাসের ঐতিহ্যকে পুরো নস্যাৎ করে দিয়েছেন। কিন্তু একই সময়ে দেশজ ইতিহাসের ধ্রুপদী ও লৌকিক ধারার গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন অনেকেই। অক্ষয়কুমার সেন ‘ইতিহাসের শিক্ষা’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, প্রায় সমস্ত দেশের প্রাচীন ইতিহাসই ‘কাল্পনিক বা অতিপ্রাকৃত কথা’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে, কাজেই এ দেশের পুরাণ লেখকদের এ ব্যাপারে দোষ দেওয়া যায় না। ‘কুলশাস্ত্র’ যে ‘একেবারে উপেক্ষার জিনিস নয়’ তা মনে করেন অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। দুর্গাচরণ সান্যালের যুক্তিতে ‘স্বদেশ প্রচলিত প্রবাদ এবং বংশানুক্রমিক কিংবদন্তি সংগ্রহ ব্যতীত আমাদের দেশের ইতিহাস সম্পূর্ণ হতে পারে না’। বর্তমানে ডেভিড কার্লে বা কুমকুম চট্টোপাধ্যায়ের রচনায় বাংলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মঙ্গলকাব্য বা কুলজির গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পূর্বতন ইতিহাস চর্চার নেতিবাচক দিকগুলি এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এক, ইতিহাসচর্চা আর কেবলমাত্র স্বদেশপ্রেম উজ্জীবনের ক্ষেত্র থাকছে না। রামপ্রাণ গুপ্ত বলছেন, ‘জাতীয় অভিমান ও স্বদেশবাৎসল্যকে ঐতিহাসিক সত্যের নিকট অবনত করা আবশ্যক।’ একই বক্তব্য রমেশচন্দ্র মজুমদারের, ‘আমাদের ঐতিহাসিক প্রেরণার মূলে সত্যনিষ্ঠা নাই আছে সংকীর্ণ স্বদেশপ্রেম বা স্বজাতিপ্রেম।’ দুই, প্রথম যুগের একপাক্ষিক আর্যপ্রীতি বা হিন্দুপ্রীতির পরিবর্তে বিভিন্ন প্রবন্ধকার অনার্য জাতিসমূহের ধর্মবিশ্বাস আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদির ইতিহাস এবং হিন্দু ব্যতীত অন্যান্য ধর্মের ইতিহাস অনুসন্ধানের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিন, বাংলার পাঠকসমাজে বাংলার হিন্দু অতীত সম্পর্কে অতিরিক্ত আকর্ষণ এবং নবাবি আমলের ইতিহাস সম্পর্কে চূড়ান্ত অনাগ্রহের তীব্র সমালোচনা করেছেন কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়। আছে কতকগুলি সদর্থক প্রস্তাবও। সুরেন্দ্রনাথ সেন কলকাতা ও অন্যান্য নগরে ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক সভা স্থাপনের প্রস্তাব করছেন। যদুনাথ মনে করেন, ‘ঐতিহাসিক গবেষণার সত্যসন্ধানী নিষ্কাম সাধককে দেশ-কাল-সমাজের ক্ষুদ্র গণ্ডির বাহিরে যাইতে হইবে।’ ঐতিহাসিকের চেতনায় জাতীয়তাবাদ, জাতি-সচেতনতা, আঞ্চলিকতাবাদের ঊর্ধ্বে ইতিহাস এক চিরন্তন সত্যের আধার হয়ে উঠল। বাঙালির ইতিহাসচিন্তা ও চর্চার এই যাত্রা বিধৃত শেখর ভৌমিকের প্রবন্ধে। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় কোশাম্বী ও নীহাররঞ্জন রায়ের রচনায় খুঁজে পেয়েছেন প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস চর্চার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি।

বাঙালির ইতিহাসচর্চার স্বভূমি। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি, রাজশাহি।
আলোচ্য ঐতিহাসিকদের মধ্যে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখেন। বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস রচনার প্রধান প্রবক্তা, রবীন্দ্র-পরিকর অক্ষয়কুমারের সার্ধশতবর্ষপূর্তির কথা বিশেষ কেউ মনে রাখেননি। এই উপলক্ষে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছে মহিষাদল রাজ কলেজ। সূচনা প্রবন্ধটি অক্ষয়কুমারের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে ধরতাই দিয়ে দেয়। ১৩০৮-’২৪ কালপর্বে প্রকাশিত অক্ষয়কুমারের পঁচিশটি প্রবন্ধ, চিঠি ও আত্মকথা এখানে সংকলিত। বাংলা ও বাংলার ইতিহাস সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলিতে অক্ষয়কুমার প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন বাঙালি ‘স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়’ ‘পৃথক জাতি’। ‘বাঙালীকে জানতে হলে কেবল আর্য্যাবর্তের আর্য্যসমাজ ধরে সকল কথা জানা যাবে না।’ প্রাক্-আধুনিক নবাবি আমলের ইতিহাস নিয়ে রচিত ‘কলিকাতা অবরোধ’ ও ‘অন্ধকূপহত্যা’ প্রবন্ধ দুটিতে সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে এস সি হিল যে খামখেয়ালিপনা ও অর্থলোলুপতার মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন, তা খণ্ডন করে জে এইচ লিটলের যুক্তিগুলি প্রতিষ্ঠা করেছেন অক্ষয়কুমার। কিন্তু সত্যই কি অক্ষয়কুমারের লেখা সিরাজদ্দৌলার রাজত্বকালের ইতিহাস পুরোপুরি নিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পেরেছিল? রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা উল্লেখ্য, ‘গ্রন্থকার যদিও সিরাজ-চরিত্রের কোনো দোষ গোপন করিতে চেষ্টা করেন নাই, তথাপি তিনি কিঞ্চিত উদ্যম সহকারে তাহার পক্ষ অবলম্বন করিয়াছেন।’ ১৯৪০-এ নেতাজির নেতৃত্বে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলনও অন্ধকূপ হত্যার মিথটির জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়ার দ্যোতক হয়ে ওঠে। এই মিথের সাম্রাজ্যবাদী ও জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার যে দ্বৈত আখ্যান নির্মিত হয়, তা সম্প্রতি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দ্য ব্ল্যাক হোল অব এমপায়ার: হিস্টরি অব গ্লোবাল প্র্যাকটিস অব পাওয়ার গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।
‘ভারতশিল্পের ইতিহাস’ প্রবন্ধে লেখক এক দিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ঐক্যসূত্র রূপে ভারতশিল্পকে তুলে ধরেছেন, অন্য দিকে প্রাচীন শিল্পের নিদর্শন যে ইতিহাসের লিখিত উপাদানের পরিপূরক, তাও চিহ্নিত করেছেন। প্রত্নবিদ্যা ও ইতিহাস সংক্রান্ত প্রবন্ধ দু’টিতে অক্ষয়কুমার জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে প্রকৃত ‘অধিকারী’র প্রশ্নটি উত্থাপন করেন ‘অনেক শাস্ত্রে অধিকার না থাকলে প্রত্নবিদ্যার অনুশীলনে অধিকার লাভ করা যায় না।’ গ্রন্থশেষে অশোক উপাধ্যায়-কৃত লেখকের রচনাপঞ্জি বইটির মূল্যবান সম্পদ।
ইতিহাস ও সাহিত্য: প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার বইটিতে সমকালীন ইতিহাস বনাম সাহিত্যের বিতর্কটি তুলে ধরা হয়েছে। প্রবোধচন্দ্র সেনের প্রবন্ধে এই বিতর্কের ধারাবাহিক পরিচয় আছে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ইতিহাসের সংশ্রবে উপন্যাসে একটি বিশেষ রস সঞ্চার করে, ইতিহাসের সেই রসটুকুর প্রতি ঔপন্যাসিকের লোভ, তাহার সত্যের প্রতি তাহার কোন খাতির নাই।’ তা ছাড়া, ‘ইতিহাসের সত্য মিথ্যা নির্ণয় করা বড় কঠিন, ...লোকের কাছে তাহা কীরূপ ঠেকিয়াছিল সেও একটা প্রধান দ্রষ্টব্য বিষয়।’ দুই, ‘ইতিহাসে এমন অনেকটা অংশই থাকে যাহার প্রমাণ অপ্রমাণ ঐতিহাসিকের ব্যক্তিগত প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।’ উত্তরে অক্ষয়কুমারের বক্তব্য, ‘ইতিহাসে যাহার যা স্বাদ উপন্যাসে তাহার সেই স্বাদ রাখিতে হইবে, যে ইতিহাসে মহাবীর উপন্যাস তাহাকে কাপুরুষ সাজাইতে পারিবে না...।’
অন্য দিকে, শিল্পের সত্য রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন অবনীন্দ্রনাথ। তিনি লিখছেন ‘ঐতিহাসিক যেটাকে fact নয় বলিয়া উড়াইয়া দিতে চাহেন তোমার কাছে ঠিক সেই নাfact-টাই বিশেষ প্রয়োজনীয় পদার্থ, কেননা সে অসত্য পলায়ন কথার ভিতর দিয়াই তুমি ‘চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি সুখানি চ’ এই মহাসত্য ঘোষণা করিবার সুযোগ পাইয়াছ।’ শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের সত্যের চেয়েও বড় জীবনের মহাসত্য। যদুনাথ সরকারও ইতিহাসের সত্যের উপরে স্থান দিয়েছিলেন শিল্পের চিরসত্যকে।
একবিংশ শতকে সাহিত্য ও ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক কেন্দ্র করে আখ্যানতত্ত্বের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে। আজ ইতিহাসের তথ্যগত সত্যতাই একমাত্র বিবেচ্য নয়, যে কোনও নির্মাণের মতোই ইতিহাসও এক নির্মাণ মাত্র এই নির্মিত সত্য নিয়ত পরিবর্তমান একটি ধারণা যা চিরন্তনও নয়, মহানও নয়, নিত্য ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী। এই নশ্বরতা স্বীকার করে নিয়েই আজকের ইতিহাসের যাত্রা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.