রান্না হচ্ছে হিটারে। টিভি চলছে কেবলে। টিভির কেবলের সঙ্গেই বিদ্যুতের তার ঢুকেছে ঘরে ঘরে। সেই তার আঁকশি বানিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে রাস্তার পাশের বিদ্যুতের তারে।
এক বছর পরেও বেআইনি বিদ্যুতের তারে ছেয়ে রয়েছে মগরাহাটের নৈনান গ্রাম। সেই নৈনান, যেখানে গত বছর ১ ডিসেম্বর হুকিং কাটতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার কর্মীরা। কর্মীদের আটক করে রেখেছিলেন গ্রামের মানুষই। তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে আক্রান্ত হয় পুলিশ। জনতা-পুলিশের খণ্ডযুদ্ধে গুলি চলে। গুলিতে এক গৃহবধূ ও এক শিশুর মৃত্যু হয়।
এক বছর পরেও নৈনানের চিত্র এতটুকু বদলায়নি। উল্টে অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ চুরি আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে। |
কী রকম? এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, “গত বছর গুলি চলার কয়েক দিন পরেই এলাকার নেতারা আমাদের বলে দিয়েছেন, পুলিশ আর বিদ্যুৎ দফতরের অফিসারেরা এখানে আর আসবেন না। তাই আমরাও নিশ্চিন্তে হুকিং করে বিদ্যুৎ নিচ্ছি।” রাজ্যের এক বিদ্যুৎ কর্তাও বললেন, “ওই সব অঞ্চলে রাজনৈতিক দলের নেতারা বিদ্যুৎ চোরদের মদত দিচ্ছেন। গত বছর যে নৈনান গ্রামে হুকিং বিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে স্থানীয় মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল, সেখানে বিদ্যুৎ চুরি আগের তুলনায় আরও বেড়ে গিয়েছে।”
কতটা বেড়েছে বিদ্যুৎ চুরি?
গত বছরের তুলনায় ওই অঞ্চলে বিদ্যুৎ চুরি আগের চেয়ে ৫ শতাংশের মতো বেড়েছে বলে বিদ্যুৎ কর্তাদেরই একাংশ জানিয়েছেন। বিদ্যুৎ দফতরের হিসেবে, মগরাহাট-নৈনান অঞ্চলে ১০০ ইউনিট বিদ্যুৎ দিলে ৬৫ ইউনিটই চুরি হয়ে যায়। বণ্টন সংস্থা সূত্রের খবর, বারুইপুর ডিভিশনের মগরাহাট এবং জয়নগরে গড়ে এখন প্রতি বছর সাড়ে তিন কোটি ইউনিট করে বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকার মতো। এলাকার এক বিদ্যুৎ কর্তা স্বীকার করছেন, “গত বছর গুলি চলার পর বিদ্যুৎ চুরির বিরুদ্ধে আর কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে ‘বার্তা’ পৌঁছে গিয়েছে। তাই যে যা খুশি করছে। আমাদেরও হাত-পা বাঁধা।”
তা হলে উপায়? রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে নৈনান, মল্লিকপাড়া ও ব্যাসপুর এলাকায় এখনও পর্যন্ত আটটি ট্রান্সফর্মার বসানো হয়েছে। ওই তিনটি গ্রামে প্রায় ১২০০ পরিবার বসবাস করেন। তিনটি গ্রামের অধিকাংশ এলাকাতে খুঁটির মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছে দাবি করছেন মগরাহাট-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি খইরুল হক। তিনি বলেন, ‘‘আরও দুটি ট্রান্সফর্মার বসানো হবে। খুঁটির সংখ্যা আরও বাড়বে।”
ট্রান্সফর্মার ও খুঁটির সংখ্যা নয় বাড়ানো হল। তাতে বিদ্যুৎ চুরির কতটা সুরাহা হবে, তা কিন্তু অস্পষ্ট। এলাকার বারোশো পরিবারের মধ্যে বিদ্যুতের বৈধ গ্রাহকসংখ্যা কত? বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা সূত্রের খবর, বিপিএল তালিকা ছাড়া ওই তিনটে গ্রাম মিলিয়ে বৈধ গ্রাহকের সংখ্যা ৫৫টির মতো। এ ছাড়া বিপিএল তালিকাভুক্ত প্রায় ১৫০টি পরিবার বৈধ সংযোগ নিয়েছেন। আরও শ’খানেক মানুষ আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। তার পর আর যোগাযোগ করেনি।
তার মানে মোট ২০৫টি বাড়িতে বৈধ বিদ্যুতের সংযোগ, কিন্তু ওই এলাকায় কেব্ল টিভির সংযোগ কত? এলাকার বাসিন্দারা জানান, কেব্ল রয়েছে সাড়ে পাঁচশোর মতো। ব্যাসপুর গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, “কেব্লের জন্য মাসে ১৫০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎ আমরা বিনামূল্যেই পাই। অনেকেই তো রান্নাবান্না সব ইলেকট্রিক হিটারেই করেন। গ্যাস-কেরোসিনে এখন অনেক খরচ!”
বিদ্যুৎ কর্তাদের বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিদ্যুতের মাসুল বাড়ানো হবে না। মুখ্যমন্ত্রীর ওই নির্দেশের জেরে বিপুল আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। গত বছর পয়লা ডিসেম্বর থেকে হুকিং বিরোধী অভিযানে নামা হয়। কিন্তু প্রথম দিনই নৈনানে ওই ঘটনা ঘটে। এর পর থেকে হুকিং বিরোধী অভিযান কার্যত বন্ধ। রাজ্যের এক বিদ্যুৎ কর্তার কথায়, “সারা রাজ্যে বিদ্যুৎ চুরির উপরে আর আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। যথেচ্ছ বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে। এখন সবাই খুশি।” বণ্টন সংস্থা সূত্রে খবর, বিদ্যুৎ চুরি রুখতে পুরোদস্তুর একটি দফতর রয়েছে। তার দায়িত্বে রয়েছেন এক জন ডিআইজি পদমর্যাদার আইপিএস অফিসার। ডিএসপি পদ থেকে অবসর নেওয়া ৫০ জনকে রাখা হয়েছে স্পেশ্যাল অফিসার হিসেবে। রয়েছেন এক জন চিফ ইঞ্জিনিয়ার-সহ কয়েক জন অফিসারও। গত এক বছর ধরে তাঁদের কোনও কাজ নেই। অভিযান বন্ধের এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল কী হয়েছে? বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার বক্তব্য, “চুরি রুখতে পারলে বছরে কমপক্ষে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা যেত। এতে বিদ্যুতের দামও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। চুরির জন্য বাড়তি বোঝার দায় বইতে হচ্ছে বৈধ গ্রাহকদেরই।” |