উত্তর কলকাতা
পানিহাটি
আশ্রয়ের সন্ধানে
দু’বছর নিজের ঘরছাড়া পানিহাটি, শতদলপল্লির বাসিন্দা বীরেন কীর্তনিয়া। কথা ছিল, নিজের কাঁচা বাড়ি ভেঙে ‘বিএসইউপি’ প্রকল্পে তৈরি হবে নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য পাকা বাড়ি। সেই আশায় ভাঙা হয়েছিল নিজের বসতবাড়িটি। কিন্তু, দু’বছরেও বাড়িতে ঢোকা তো দূর অস্ৎ, ছাদই হল না সে বাড়ির। তাই নির্মীয়মাণ বাড়ির পাশের ড্রেনের উপরে তৈরি অস্থায়ী, ঝুলন্ত ঘরে সপরিবার বাস করছেন পেশায় রাজমিস্ত্রি বীরেনবাবু। আর প্রতি দিন ঝুঁকি নিয়ে চলছে পারাপার।
একই ভাবে নিজের কাঁচা বাড়ি ছেড়ে পাশের ভাড়া বাড়িতে উঠেছিলেন লক্ষ্মীদেবী। চালচুলোহীন সংসারে মাস পেরোলে ১৫০০ টাকা ঘর ভাড়ার চাপ সামলাতে পারছিলেন না। কার্যত ঘটিবাটি বন্ধক রেখে চড়া সুদে মহাজনের ঘর থেকে টাকা নিয়ে শেষ করেছেন ‘বিএসইউপি’ প্রকল্পের বাড়ি। সোনার গয়না বন্ধক রেখে তবেই ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ করেছেন মিনতি সাধক। এমনও বেশ কিছু বাড়ি আছে, যেগুলো ভিত পর্যন্ত হয়ে পড়ে আছে বছরখানেক। নিম্নবিত্ত মানুষের দুর্ভোগের কয়েকটি নমুনা এগুলি।
দুর্ভোগের জেরে পর্যুদস্ত হচ্ছেন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশন-এর (জেএনএনইউআরএম) অন্তর্গত বেসিক সার্ভিসেস ফর আরবান পুওর (বিএসইউপি) প্রকল্পে দরিদ্র মানুষের জন্য বাড়ি তৈরির সূচনা হয় ২০০৭-এ। প্রথম পর্যায়ে ঠিক হয়, পাকা বাড়ি তৈরিতে প্রতি আবেদনকারীকে এক লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে ক্রমবর্ধমান বাজারদরের কথা মাথায় রেখে টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয় এক লক্ষ কুড়ি হাজার। আবেদনকারী পুরসভাকে ২০ হাজার টাকা জমা দিলে মিলবে বাকি টাকা। বাকি এক লক্ষ টাকার মধ্যে রাজ্য ও কেন্দ্র দেবে ৩০ শতাংশ করে। কেএমডিএ ৩৫ শতাংশ এবং সংশ্লিষ্ট পুরসভা ৫ শতাংশ।
২০১০ সালে ঘোষিত দ্বিতীয় পর্যায়ের টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয় ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য আবেদনকারীকে জমা করতে হবে ২৫ হাজার টাকা। বাকি নিয়ম একই। পানিহাটিতে প্রথম পর্যায়ে প্রস্তাবিত বারোশোটি বাড়ির মধ্যে সাতশোটি হয়ে বন্ধ হয়েছে ওই পর্যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে আড়াই হাজারের মধ্যে এখনও পর্যন্ত হয়েছে সতেরোশো বাড়ি।
বাড়ি তৈরির সময়ে মোট ছ’টি ধাপে আবেদনকারীকে টাকা দেয় পুরসভা। অভিযোগ, সেই টাকাই পাচ্ছেন না বাসিন্দারা। লক্ষ্মীদেবী, মিনতিদেবীদের বক্তব্য, পুরসভার দেওয়া নির্দিষ্ট দিনে টাকা আনতে গিয়ে আবেদনকারীদের খালি হাতে ফিরে আসতে হচ্ছে বার বার। অন্য দিকে, অনেক দিন ধরে কাজ চলায় বাজারদর বাড়ছে। ঠিকাদারেরা চাপ দিচ্ছেন নিজেদের টাকায় কাজ শেষ করার জন্য। পরে পুরসভায় টাকা এলে সেই টাকা ঠিকাদারের মাধ্যমে ফিরে পাওয়া যাবে ঠিকই। কিন্তু সেটা কবে?”
প্রশ্নের উত্তর নেই পানিহাটি পুরসভার কাছে। পুরপ্রধান চারণ চক্রবর্তী বলছেন, “প্রথম পর্যায়ের আবেদন নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ। এই পর্যায়ের প্রায় তিন কোটি টাকা পুরসভা পাবে। গরিব মানুষের কথা ভেবে বহু বার টাকার তাগাদা দিচ্ছি। কোনও লাভ নেই। শুধু জানা গিয়েছে, কেএমডিএ থেকে ওই বকেয়া টাকা মঞ্জুর হয়ে সেন্ট্রাল স্ক্রিনিং মনিটরিং কমিটির বৈঠকে অনুমোদন পেয়েছে এক বছর আগে। তবু সেখান থেকে ফাইল কেন নড়েনি জানা নেই। এর পর সেন্ট্রাল ফিনান্স থেকে নগোরন্নয়ন দফতর হয়ে টাকা আসার কথা স্টেট ফিনান্সে। তার পরে পাবে পুরসভা। ফলে, ওই টাকা কবে পাব জানি না।” তিনি জানান, দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের জন্যও ঠিকমতো টাকা আসছে না। ফলে অনেকেই এসে ফিরে যাচ্ছেন।
আবেদনকারীদের একাংশের অভিযোগ, পুরসভার কাছে টাকা না থাকলে কয়েক জন পাচ্ছেন কী করে? যাঁরা তিন-চার মাস আগে ছাদ ঢালাইয়ের টাকার আবেদন করেছেন তাঁরা না পেলেও মাত্র দশ দিন আগে আবেদন করেও অনেকে টাকা পাচ্ছেন। এতে প্রকৃত দাবিদারেরা বঞ্চিত হচ্ছেন। যদিও পানিহাটি পুরসভার উপপ্রধান পঙ্কজ দাসের কথায়: “দরিদ্র মানুষের কথা ভেবে ইতিমধ্যে পুরসভা বহু টাকা খরচ করেছে। ফলে এলাকার উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সরকার টাকা না দিলে বাকি টাকা কী ভাবে দেব?” অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে তাঁর অভিমত, “এতগুলি কাজের মধ্যে দু’-একটি ক্ষেত্রে অনিয়ম হতে পারে। প্রমাণ-সহ জানালে অবশ্যই বাধা দেব।”
কেএমডিএ-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিমাদ্রি দে বলছেন, “ডিসবার্সমেন্ট অথরিটি হিসাবে কেএমডিএ পরিদর্শন করে থাকে। প্রকল্পের নিয়ম মেনে পুরসভা যদি কাজ করে তবে টাকা পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ের টাকা পানিহাটি কেন পাচ্ছে না দেখতে হবে।”
ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.