পুরুলিয়াকে সবুজায়ন করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাই ‘রূপসী বাংলা’ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক বছর আগে পুরুলিয়ার প্রশাসনিক বৈঠকে নিজের এই ইচ্ছার কথা বলে আধিকারিকদের সর্বস্তরে সমন্বয় রেখে কাজ করতে নিদের্শ দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্রেফ প্রশাসনিক সমন্বয় ও পরিকল্পনার অভাবেই খরাপ্রবণ এই জেলায় কয়েক লক্ষ তাজা চারাগাছ নষ্ট হতে বসেছে। বছর দুয়েক আগের খরা ও অনাবৃষ্টির টাটকা স্মৃতির এই জেলার সবুজায়নের এক উদ্যোগও একই সঙ্গে নষ্ট হতে চলেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, ১০০ দিনের প্রকল্পে চারা গাছ তৈরি করতে লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেও সেই চারাগাছ কোথায় লাগানো হবে, সে পরিকল্পনা করা হয়নি। ফলে প্রচুর পরিমাণ ফল ও ওষধি চারা গাছ তৈরি করেও বিলি করতে না পারায় এখন ফাঁপরে পড়েছে সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ (কম্প্রিহেনসিভ এরিয়া ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন বা সিএডিসি)। তাদের দাবি, লাখ দুয়েক চারা গাছ ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। শীতের দাপটে বাকি প্রায় লাখ সাতেক চারাও নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চারাগুলি বাঁচাতে পুরুলিয়ার সিএডিসি কর্তৃপক্ষ গত দু’মাসে জেলা প্রশাসনের কাছে একাধিকবার চিঠি লিখেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। |
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, চারাগাছ তৈরির জন্য গত জুন মাসে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প থেকে ৩০ লক্ষ টাকা পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের অধীন সিএডিসি-র সাহারজোড় প্রকল্পকে বরাদ্দ করা হয়। ১০০ দিন কাজের জন্য জবকার্ড তৈরি করেও শারীরিক দুর্বলতা ও অন্যান্য সমস্যার জন্য যাঁরা এতদিন কাজ করতে পারেননি, তাঁদের ওই কাজে নামানো হয়। জবকার্ডধারী স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অনেক সদস্যাও গোষ্ঠীগত ভাবে অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে চারা তৈরি করেন। প্রায় চার হাজার কর্মী কাজ করেন। সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ায় সমস্ত চারাগাছ মাটিতে রোপন করার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
সাহারজোড়ের প্রকল্প আধিকারিক নিত্যানন্দ চক্রবর্তী বলেন, “কম জমি ব্যবহার করে ৯ লক্ষ ১৪ হাজার ৯১০টি চারা তৈরি করেছি। তার মধ্যে জেলা প্রশাসন ৩৪ হাজার ৯২০টি চারা গাছ নিয়ে যায়। পঞ্চায়েত, বন দফতর-সহ নানা জায়গায় তা বিলি করা হয়। কিন্তু বাকি চারা পড়ে রয়েছে। এরই মধ্যে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার ৭৫০টি চারা মরে গিয়েছে।” কৃষিবিজ্ঞানী নিত্যানন্দবাবু জানান, চারাগুলির গোড়ায় অল্পমাটি লাগিয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেটে রাখা আছে। পরিচর্যা করে এ ভাবে বড়জোর মাস তিনেক রাখা যায়। তারপর প্যাকেট ফাটিয়ে গাছগুলি জমিতে শিকড় মেলে দেবে। পরে ওই গাছ তুলতে গেলে শিকড় ছিঁড়ে যাবে। তখন গাছ বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়বে।
ঝালদা ২ ব্লকের বেগুনকোদরে সিএডিসি-র নিজস্ব জমিতে এবং জেলার অন্যান্য এলাকায় বাবলা, কুল, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, পেঁপে, সজনে, অর্জুন, আমলকি, শিরীষ, নিম, পেয়ারা, কাঁঠাল, সেগুন, জাম, গামার, শিমূল, সুবাবুল, কুসুম, বহড়া-সহ নানা ধরনের ফল ও ওষধি গাছের চারা তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। এত দিন যাঁরা ওই চারাগুলি তৈরি করেছেন, তাঁরাই এখন বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। বেগুকোদরের বাসিন্দা মঞ্জু পরামানিক, সঙ্গীতা সেনগুপ্তদের কথায়, “২০০৬ সালে জবকার্ড পেয়েও নানা সমস্যায় ভারি কাজ করতে যেতে পারিনি। শেষে এখানে চারা তৈরির কাজ পাই। পারিশ্রমিকও পেয়েছি। কিন্তু চারাগুলো বাঁচাতে না পারলে সব ব্যর্থ হয়ে যাবে।” রিগিদ শিশু নারী কল্যাণ মহিলা সঙ্ঘের মিলনি মহাদানি, বামনিয়া-বেলাডি অগ্রগামী সঙ্ঘের আরতি মাহাতোদেরও আক্ষেপ, “যত্ন দিয়ে তৈরি করা চারাগুলো চোখের সামনে নষ্ট হয়ে গেলে খুব কষ্ট হবে।”
চারাগুলোর ভবিষ্যৎ কী?
স্পষ্ট জবাব মেলেনি প্রশাসনের কর্তাদের কাছে। জেলাশাসক গুলাম আলি আনসারি বলছেন, “আমি জেলার দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকে ওই সমস্যা। সম্প্রতি বিষয়টি নজরে এসেছে। গাছ লাগানোর মরশুমও প্রায় শেষ। দেখছি কী করা যায়।” ১০০ দিন কাজের প্রকল্পের জেলা নোডাল অফিসার অরূপ দত্ত বলেন, “সমস্যার কথা শুনেছি। সিএডিসি-র প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করব।” তাঁর দফতর সূত্রের খবর, সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পে ওই চারাগাছ বিলি করা হবে বলে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু কোথায়, কত চারাগাছ দেওয়া হবে, তার বিশদ তালিকা তৈরি করা হয়নি। জেলার বিধায়ক তথা রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্তি প্রকল্পের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো বলেন, “এই উদ্যোগ নষ্ট হোক চাই না। চারাগুলো নিয়ে কী করা যায় ভেবে দেখছি।”
জেলা প্রশাসনেরই কিছু আধিকারিকের মতে, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বনসৃজন করা গেলে সরকারি আয় বাড়ত। নিদেনপক্ষে রাস্তার পাশে বসালেও পথচারীরা ছায়া পেতেন। বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরুলিয়া জেলার মোট আয়তন সাড়ে ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার। তার মধ্যে ১২০০ বর্গ কিলোমিটার বনাঞ্চল। অর্থাৎ জেলার মোট আয়তনের মাত্র ২০ শতাংশ বনভূমি। ডিএফও (পুরুলিয়া) অজয়কুমার দাসের কথায়, “এই জেলায় গাছ লাগানোর প্রচুর জায়গা রয়েছে। সবুজায়নের প্রয়োজন রয়েছে।” তা সত্ত্বেও ওই চারাগুলোর ভবিষ্যৎ কী, জবাব মেলেনি। |