প্রেস কাউন্সিলের সভাপতি, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিছু সুপরামর্শ দিয়াছেন। ইতিপূর্বে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সাহস ও সততার প্রশংসা করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার এ বারের পরামর্শে মুখ্যমন্ত্রীর অসহিষ্ণুতা ও খামখেয়ালিপনা শুধরাইবার উপদেশ রহিয়াছে। ওই দুই প্রবণতার দৃষ্টান্ত হিসাবে কাটজু কয়েকটি ঘটনারও উল্লেখ করিয়াছেন, যথা তাঁহার ব্যঙ্গমূলক চিত্র প্রচারের জন্য অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেফতার, সারের দাম বাড়িতেছে কেন প্রশ্ন করার অপরাধে শিলাদিত্য চৌধুরীকে মাওবাদী তকমা দিয়া গ্রেফতার, অস্বস্তিকর প্রশ্ন করায় টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে আমন্ত্রিত ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজকেও ‘মাওবাদী’ আখ্যা দিয়া সভা-ত্যাগ ইত্যাদি। এই সব কিছুর মধ্যেই যে তীব্র অসহিষ্ণুতা প্রকট, তাহা ক্ষমতাসীনের সমালোচনা শুনিতে না-চাওয়ার দম্ভ। বিচারপতি কাটজু মুখ্যমন্ত্রীকে ইহা সংশোধন করিতে বলিয়াছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো পরিবর্তনের মন্ত্রেই দীক্ষিত। দীক্ষাদাত্রীও। এই মন্ত্র উচ্চারণ করিয়াই তিনি নির্বাচনে লড়াই করিয়াছেন এবং জয়ী হইয়াছেন। আপন স্বভাব এবং আচরণের পরিবর্তনে তাঁহার অসুবিধা কোথায়? গাঁধীজি বলিয়াছিলেন: যে পরিবর্তন দেখিতে চাও, নিজে সেই পরিবর্তন হইয়া ওঠো। কাটজু লক্ষ করিয়াছেন, মন্ত্রী, পারিষদ ও আমলাবর্গ মুখ্যমন্ত্রীকে ভয় পান, নির্ভয়ে কোনও সৎ পরামর্শ দিবার কিংবা ভুলভ্রান্তি ধরাইয়া দিবার সাহস তাঁহাদের নাই। ইহা যে স্বাস্থ্যকর নয়, তাহা কি মুখ্যমন্ত্রীও নিভৃতে স্বীকার করিবেন না? প্রসঙ্গত, কাটজু দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই পটেলের উল্লেখ করেন, যিনি কঠোর প্রশাসক তথা লৌহমানব বলিয়া পরিচিত হইলেও সচিব ও দফতরের আমলাদের মন খুলিয়া এবং নির্ভয়ে মতামত দিতে উৎসাহিত করিতেন। পটেলের বক্তব্য ছিল, যদি বিরুদ্ধ মত দিতে আমলা-অফিসাররা ভয় পান, তবে চাটুকারদের অপশাসন কায়েম হইবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে কঠোর প্রশাসক হিসাবে দেখাইতে ভালবাসেন, কিন্তু তাঁহার সহিত বল্লভভাই পটেলের বিস্তর প্রভেদ রহিয়াছে। তিনি যে পটেলের রাজধর্ম কিংবা কাটজুর পরামর্শ অনুসরণ করিবেন না, নিজের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তাহা বুঝাইয়া দিয়াছেন। সমালোচক তথা পরামর্শদাতাদের তিনি ‘বাজারে রাজাকে (নাকি হাতিকে) দেখিয়া ঘেউ-ঘেউ করা কুকুরদের’ সহিত তুলনা করিয়া জানাইয়া দিয়াছেন, সমালোচকদের সম্পর্কে তিনি কী ভাবেন এবং কী ভাবে ও কোন ভাষায় ভাবেন। নিজেকে তিনি শুধরাইবেন কিংবা তাঁহার কৃতকর্মের ফলে বিপর্যস্ত মানুষগুলির কাছে নিজ আচরণের জন্য দুঃখপ্রকাশ করিবেন, এমন সম্ভাবনা অতএব দূরপরাহত। চারিপাশে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ভূত দেখিয়া সেই কাল্পনিক ভূতেদের বিরুদ্ধে তাঁহার সংগ্রামী অভিযান প্রত্যক্ষ করাই আপাতত বঙ্গবাসীর নিয়তি।
ইহার পিছনে কি এক ধরনের মানসিক নিরাপত্তাহীনতা কাজ করিতেছে? মন্ত্রী, নেতা, সরকারি অফিসারদের আনুগত্য বিষয়ে সংশয়ই কি মুখ্যমন্ত্রীকে কুরিয়া খাইতেছে? রাজ্য-রাজনীতিতে যখন তিনি বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তখনও তিনি ষড়যন্ত্রের শঙ্কা প্রকাশ করিতেন তাঁহাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র, শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার চক্রান্ত, ইত্যাদি। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এখন তিনি তাঁহার সরকারের ‘ভাল-ভাল’ কাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত অন্বেষণ করিয়া বেড়ান। সংশয় হয়, তিনি বুঝি-বা এক ধরনের ‘অবরুদ্ধ হওয়ার মানসিকতা’য় আচ্ছন্ন। এমন মানসিকতাই বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার নবীন সোভিয়েত রাষ্ট্র ও বলশেভিক পার্টির নেতাদের গ্রাস করিয়াছিল। যে কোনও ত্রুটিবিচ্যুতির উল্লেখ, সরকারের যে কোনও কাজের ভুলভ্রান্তি ধরাইয়া দেওয়াকেই চক্রান্ত ভাবিবার স্পর্শকাতরতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনপ্রণালীর স্নায়বিক দৌর্বল্যই প্রকট করিয়া দিতেছে। শুধু প্রশংসা শুনিবার আগ্রহ, ভুলভ্রান্তির কথা তুলিলেই তাহাকে ‘নেতিবাচক সমালোচনা’ ও ষড়যন্ত্র বলিয়া প্রচার করার প্রবণতা কিন্তু কালক্রমে ব্যুমেরাং হইতে পারে। স্তাবক ও চাটুকারদের সমস্বর বন্দনাগান শ্রুতিমধুর, কিন্তু বিপজ্জনক। |