|
|
|
|
রইল ‘গুজরাল ডকট্রিন’, প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন আগেই। পরিবার, বই, উর্দু কবিতা আর এক রাশ ভাবনা নিয়ে ডুবে থাকতেন নিজের জগতে। আজ বিদায়ও নিলেন প্রায় নিঃশব্দেই।
ইন্দ্রকুমার গুজরাল। কূটনীতিক। নিপাট ভদ্রলোক রাজনীতিক। দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।
অনেকে বলেন, বরাত জোরে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ছিলেন এক বছরেরও কম সময়। কিন্তু ওই অল্প সময়টুকুতেই ছাপ ফেলে গিয়েছিলেন। আজও ‘গুজরাল ডকট্রিন’ রাজধানীর ক্ষমতার অলিন্দে আলোচনার বিষয়। এ সেই ‘ডকট্রিন’, যা বিতর্কিত, কিন্তু প্রাসঙ্গিক। এই ‘ডকট্রিনে’ই গুজরাল বলেছিলেন, ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
৯২ বছর বয়সে আজ প্রয়াণ হল গুজরালের। দিল্লির উপকণ্ঠে এক হাসপাতালে। ফুসফুসে সংক্রমণের জন্য ক’দিন আগেই ভর্তি হয়েছিলেন। চিকিৎসা চলছিল পুরো দমে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেন চিকিৎসকরা। আজ দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্দে লোকসভায় সেই কথা ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গে মুলতুবি হয়ে যায় সংসদ। সন্ধ্যায় মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী। বললেন, এক বন্ধুকে হারালেন তিনি।
শোকবার্তা এসেছে সব দলের পক্ষ থেকেই। শোক জানিয়েছেন প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গুজরালের অবদান স্মরণ করেন তিনি। আওয়ামি লিগের প্রিসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফারুল্লা আগামিকাল দিল্লি আসছেন। এক কঠিন সময়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন গুজরাল। মিতভাষী, মৃদুভাষী গুজরালের প্রধানমন্ত্রী হওয়াটাই অনেকের কাছে বিস্ময়ের ছিল। কিন্তু অল্প কিছু দিনের জন্য হলেও জোট সরকার চালিয়ে গিয়েছিলেন মুন্সিয়ানার সঙ্গে। সব দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন তিনি। যথাসম্ভব এড়াতেন বিতর্ক।
সব সময় বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে পারেনওনি অবশ্য। গুজরালেরই প্রধানমন্ত্রিত্বে পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে জড়ালেন জনতা দল সভাপতি লালুপ্রসাদ যাদব। গুজরাল তেমন কোনও পদক্ষেপই করলেন না। উল্টে সিবিআই-প্রধানকেই বদলি করে দিলেন। বিতর্ক বাধল উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সিদ্ধান্ত নিয়েও। রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন সেই সুপারিশ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
গুজরালের জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের ঝিলামে। পরিবারের অনেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। গুজরালও ভারত-ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলে যান। দেশভাগের পর দিল্লি চলে আসার পর থেকে ওতপ্রোত ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৪ সালে প্রথম বার রাজ্যসভার সদস্য হন। ১৯৬৬ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে ইন্দিরা গাঁধীর অভিষেকে যাঁদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, গুজরাল তাঁদের মধ্যে এক জন। পরে ইন্দিরার মন্ত্রিসভাতেও যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা চালু হওয়ার সময় কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ছিলেন গুজরালই।
কিন্তু তার পরেই ইন্দিরা-পুত্র সঞ্জয়ের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য শুরু হয়। ইন্দিরা তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে ভারতের রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মস্কোয়।
জরুরি অবস্থার সেই বিতর্কিত পর্বে গুজরাল কংগ্রেস ছাড়েননি। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি এসে কংগ্রেস ছেড়ে যোগ দেন জনতা দলে। ১৯৮৯ সালে জালন্ধর থেকে লোকসভা নির্বাচন জিতে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের সরকারে বিদেশমন্ত্রী হলেন। সেটা ছিল ইরাকের কুয়েত আক্রমণ এবং উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়। এর পরে ১৯৯৬-এর নির্বাচনের পর দেবগৌড়া সরকারেও বিদেশমন্ত্রী হয়েছিলেন গুজরাল। তার পর কংগ্রেস দেবগৌড়ার উপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার পরে নিজে প্রধানমন্ত্রী হলেন। ১৯৯৭-এর এপ্রিল থেকে নভেম্বর, স্বল্পমেয়াদি সেই প্রধামন্ত্রিত্বের পর্বেও বিদেশনীতিতেই সবথেকে বেশি জোর দিয়েছিলেন তিনি। বরাবর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন। এমনকী ১৯৯৮-এর নির্বাচনে অকালি দলের সাংসদ হয়ে লোকসভায় আসা গুজরাল বিজেপির সমালোচনা করেও বাজপেয়ীর লাহৌর যাত্রাকে সমর্থন করেছিলেন।
১৯৯৮ সালেই শেষ বার নির্বাচনে লড়েছিলেন গুজরাল। ১৯৯৯-এর ভোটে আর দাঁড়াননি। তার পর থেকেই নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছিলেন। কালেভদ্রে রাজনীতি নিয়ে নিজের মতামত জানিয়েছেন। নিজের জগতে নিজের মতো করে বাঁচতে শুরু করেছিলেন। স্ত্রী শীলা ছিলেন নামী কবি। গত বছর মারা যান। ভাই সতীশ গুজরাল বিখ্যাত শিল্পী। দুই ছেলের মধ্যে নরেশ গুজরাল বর্তমানে রাজ্যসভার সদস্য।
আগামী কাল অন্তিম শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য গুজরালের দেহ আনা হবে তাঁর বাসভবনে। বিকেল তিনটে নাগাদ শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে জগজীবন রামের স্মৃতিজড়িত সমতা স্থলে। আগামী সাত দিন রাষ্ট্রীয় শোক। |
|
|
|
|
|