|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
দূষণে সবুজ হারানোর জোরালো প্রতিবাদ |
সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল রাখী রায়ের দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ। |
সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে রাখী রায়ের ছবির দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী হল। শিরোনাম ‘ইন কোয়েস্ট অব গ্রিন’। পরিবেশ দূষণের ফলে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে। এরই বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী চেতনা। ১৯৯৬তে বিশাখাপত্তনমের সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেছেন তিনি। তার পর থেকে নিজস্ব প্রয়াসে ছবি আঁকাতেই নিমগ্ন রয়েছেন। কিছু দিন অবশ্য অনুশীলন করেছেন কলকাতার বিড়লা ইনস্টিটিউট অব লিবারাল আর্টস এবং অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের স্কেচিং ক্লাবে। দীর্ঘ দিন ধরে নানা আঙ্গিকে চর্চা করেছেন। একটা পর্যায়ে স্বাভাবিকতা আশ্রিত আঙ্গিকে সমাজবাস্তবতামূলক বিষয় নিয়ে এঁকেছেন। তার পর তাঁর ছবির রূপকল্প ধীরে ধীরে ভেঙেছে। স্বাভাবিকতাকে অতিক্রম করে কল্পরূপ বা ফ্যান্টাসির দিকে গেছেন। স্বাভাবিকতার রীতির অঙ্কনে তাঁর ভিতটি দৃঢ় হওয়ায় তাঁর কল্পরূপেও গাঠনিক বৈশিষ্ট্য এসেছে। এখন তিনি যে আঙ্গিকে আঁকেন তা ‘রোম্যান্টিক রেবেলিয়ন’ বা প্রতিবাদী চেতনা সঞ্জাত। সেদিক থেকে এর খানিকটা ঝোঁক রয়েছে সুররিয়ালিজমের দিকে। কিন্তু এই সুররিয়ালিজম পাশ্চাত্যের ধরনের নয়। অবিশ্বাসের তীব্রতায় বিদ্রুপাত্মক ভাঙন থেকে উঠে আসেনি। বরং এর মধ্যে আছে সুস্মিত সৌন্দর্যচেতনা, জীবনের সদর্থকতায় বিশ্বাসের এক পরিমণ্ডল।
তাঁর আঙ্গিকের মূল ভিত্তি স্বদেশচেতনা এবং ঐতিহ্যের প্রতি আস্থা। আমাদের চিত্রকলার আধুনিকতায় ‘শিল্পের স্বদেশ’ সন্ধানের সূচনা হয়েছে বিংশ শতকের গোড়া থেকে। অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রথম পথিকৃৎ। প্রাচ্যের নানা উৎস থেকে তিনি রূপ সন্ধান করেছেন। গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন পাশ্চাত্য নিরপেক্ষ স্বকীয় এক আঙ্গিক পদ্ধতি। স্বদেশসন্ধানের এই ভাবনা তাঁর শিষ্য পরম্পরার মধ্য দিয়ে নানা শাখা-প্রশাখায় রূপান্তরিত হয়েছে। গড়ে উঠেছে নব্য-ভারতীয় ঘরানা। নন্দলাল বসু ছিলেন এই ঘরানার অন্যতম। তাঁর ছবিতে যে পাশ্চাত্য-বিরোধী নিবিড় স্বদেশসম্পৃক্ততা, সেখানেই রুদ্ধ হয়ে থাকেনি প্রাচ্যচেতনা সঞ্জাত আধুনিকতা। শান্তিনিকেতন ঘরানায় এর প্রসার ঘটেছে অনেক। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ধ্রুপদী প্রশান্তির দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাচ্যচেতনার এক আলোকিত প্রকাশভঙ্গি তৈরি করেছেন। |
|
শিল্পী: রাখী রায় |
অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বা বিনোদবিহারীর ছবিতে ঐতিহ্য-অন্বিত আঙ্গিকের ভিতর প্রচ্ছন্ন এক আধ্যাত্মিকতাও ছিল। পূর্বসূরি হিসেবে যামিনী রায়ের প্রভাব কাজ করেছে সেখানে। নীরদ মজুমদারের তন্ত্র-ভিত্তিক আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি গোপাল ঘোষের নিসর্গে উন্মীলিত হয়েছে মরমি বিস্ময়বোধ। ১৯৬০-এর দশকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংশ্লেষের ভিতর দিয়েই গড়ে উঠেছে আত্মপরিচয় নির্মাণের যে প্রবণতা তাতে প্রতিবাদী চেতনা থেকেই উদ্ভাসিত হয়েছে আধ্যাত্মিকতার বিশেষ এক রূপ। গণেশ পাইন বা যোগেন চৌধুরীর ছবি অন্যতম দৃষ্টান্ত।
রাখী রায় বিশ্বায়ন-সঞ্জাত সামাজিক বাতাবরণে উত্তর-আধুনিকতা-অতিক্রান্ত যুগের এক মানবী শিল্পী। মানবীচেতনার ভিতর দিয়েই তিনি বিশ্বায়ন-উদ্ভূত পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকটিকে অনুধাবন করেছেন। তাঁর প্রতিবাদী চেতনাকে তিনি প্রবাহিত করেছেন আধ্যাত্মিকতার দিকে। নব্য ভারতীয় ঘরানা থেকে শুরু হয়েছেল যে স্বদেশসন্ধান একবিংশ শতকে পৌঁছে তা যেমন বিপর্যস্ত হয়েছে, তেমনি নানা নতুন দিকে উন্মীলিতও হয়েছে। রাখীর ছবিতে সেই উন্মীলন দেখতে পাই। স্বাভাবিকতার ভিত্তি থেকে তিনি কল্পরূপের দিকে গেছেন। পুরাণকল্পের সঙ্গে আধুনিক জীবনকে মিলিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই আত্মপ্রক্ষেপ ঘটেছে। প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করেছেন। তারপর বাস্তবের আবরণ উন্মোচন করে কল্পরূপের দিকে গেছেন। অলঙ্করণময়তা সেখানে হয়ে উঠেছে তাঁর প্রকাশের প্রধান ভিত্তি। ‘মণ্ডল’ শীর্ষক ছবিটি যার দৃষ্টান্ত।
জীবন ও প্রকৃতির একাত্মতা তাঁর ছবির প্রধান ভিত্তি। ‘আদি শক্তি’ ছবিতে দেখি একটি গাছ উঠে গেছে। তার পাদমূলে সূর্যশিখা। কোনও নারীর দু’টি হাত দু’পাশ থেকে তাকে ছুঁয়ে আছে। কাণ্ডের বৃত্তাকার পত্রপল্লবে উদ্ভাসিত মানবীর মুখ। কোথাও বা করপল্লবে সমর্পণের ইঙ্গিত। ‘নীলিমা’ ছবিটিতে নীলিম পরিমণ্ডলে পুষ্পিত বৃক্ষের তলায় বসে আছে এক মানবী। স্থলচর, জলচর ও আকাশবিহারী প্রাণীরা ঘিরে রয়েছে তাঁকে। এ ভাবেই প্রকৃতি ও জীবনের একাত্মতাকে নানা ভাবে অভিব্যক্ত করেছেন শিল্পী। |
|