ফেসবুকে কার্টুন-কাণ্ডে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে কীসের ভিত্তিতে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে তা জানতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট। চার সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যকে এ বিষয়ে হলফনামা পেশ করতে হবে শীর্ষ আদালতে। ফেসবুকে নিজেদের মতামত প্রকাশ করায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের যৌক্তিকতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে সম্প্রতি একটি জনস্বার্থ-মামলা দায়ের হয়েছে। শুক্রবার তারই শুনানিতে প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীরের ডিভিশন বেঞ্চ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে ওই ব্যাখ্যা তলব করেছে। গ্রেফতারির কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে মহারাষ্ট্র, পুদুচেরি ও দিল্লিকেও।
গত ১৮ নভেম্বর বালাসাহেব ঠাকরের মৃত্যুর পরে মুম্বই শহর ‘অঘোষিত বন্ধের চেহারা’ নেওয়ার সমালোচনা করে ফেসবুকে কিছু লিখেছিলেন শাহিন ধাদা নামে এক তরুণী। রিণু শ্রীনিবাস নামে আর এক তরুণী তা সমর্থন (লাইক) করেন। থানে জেলার পালঘরের বাসিন্দা দু’টি মেয়েকেই গ্রেফতার করে মহারাষ্ট্রের পুলিশ, যা নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায়। মূলত ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে শ্রেয়া সিঙ্ঘল নামে দিল্লির এক ছাত্রী সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থের মামলাটি দায়ের করেছেন। আবেদনে ২০০০ সালে তৈরি তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারাটি খারিজের আর্জি জানিয়েছেন শ্রেয়া। মহারাষ্ট্রের পুলিশ ওই ধারাবলেই শাহিন-রিনুকে গ্রেফতার করেছিল।
শুধু মহারাষ্ট্র নয়। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে মতামত জানানোর জন্য দেশের অন্যান্য প্রান্তেও যে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, শ্রেয়া আবেদনে তার উল্লেখ করেছেন। এবং এই সূত্রেই ফের সামনে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের কার্টুন-কাণ্ড। গত এপ্রিলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি রঙ্গ-চিত্র ই-মেলে ফরওয়ার্ড করার অভিযোগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র ও একই আবাসনের বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার সুব্রত সেনগুপ্তকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ওই ঘটনা নিয়েও দেশ জুড়ে শোরগোল পড়ে। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন দু’জনকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে রাজ্যের কাছে সুপারিশ পাঠায়, এমনকী সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশও করে। যদিও তার কোনওটাই এখনও মানা হয়নি। পূর্ব যাদবপুর থানার ওই দুই অফিসার অতিরিক্ত ওসি মিলনকুমার দাস এবং সাব-ইন্সপেক্টর সঞ্জয় বিশ্বাস সেখানেই বহাল রয়েছেন।
শ্রেয়ার আবেদনে অম্বিকেশবাবুদের গ্রেফতারির উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ফেসবুকে মন্তব্য করার ‘অপরাধে’ পুদুচেরি ও দিল্লিতে আরও দু’টি গ্রেফতারের প্রসঙ্গও রয়েছে। “প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশের আচরণ বাক্স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার হরণ করছে। সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করুক।” বলেছেন শ্রেয়া।
আর সেই আবেদনের ভিত্তিতেই গ্রেফতারির কৈফিয়ৎ চেয়ে চার রাজ্যকে এ দিন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের নোটিস। বেঞ্চ জানতে চায়, কোন আইনের ভিত্তিতে ওঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালতের কথায়, “ফেসবুকে মতামত দেওয়ার জন্য অল্পবয়সীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর কার্টুন সংক্রান্ত ই-মেল পাঠানোয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকও গ্রেফতার হয়েছেন! এমন কিছু করা দরকার, যাতে ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনা না ঘটে।” বিষয়টি নিয়ে আগে কেউ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন পেশ না-করায় বিস্ময়ও প্রকাশ করেছে ডিভিশন বেঞ্চ। “স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত যাতে এ ধরনের মামলা গ্রহণ করতে পারে, সেটাও আমরা খতিয়ে দেখছি।” মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি। ছ’সপ্তাহ পরে মামলাটি ফের শুনানির জন্য উঠবে।
অম্বিকেশবাবুদের গ্রেফতারে জড়িত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও তদন্ত শুরু না-করলেও থানের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্মীদের ইতিমধ্যে সাসপেন্ড করেছে মহারাষ্ট্র সরকার। প্রসঙ্গত, প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মার্কণ্ডেয় কাটজু বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে ই-মেলটি পাঠিয়েছেন, তাতে মহারাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনায় এ দিন সুপ্রিম কোর্টের নোটিসের খবর শুনে অম্বিকেশবাবু বলেছেন, “আশা করি, রাজ্য সরকার শীর্ষ আদালতকে ঠিকঠাক জবাব দেবে। স্বীকার করবে যে, আমাদের অনৈতিক ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছিল।”
কী করবে রাজ্য সরকার?
রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট ঠিক কী বলেছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রসঙ্গ কী ভাবে এল, নির্দেশের প্রতিলিপি না পেলে তা বোঝা যাবে না। প্রতিলিপি পেলে কিংবা নোটিস এলে আমরা আমাদের বক্তব্য জানাব।”
তবে ফেসবুকের জেরে গ্রেফতারির মতো ঘটনা ঘটা যে অবাঞ্ছিত, এ দিন সুপ্রিম কোর্টে শুনানির সময়ে তা স্বীকার করে নিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল জি ই বাহানবতি। তিনি বলেন, “তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা বাতিলের কোন প্রয়োজন নেই। বরং ধারাটির অপপ্রয়োগ যাতে না হয়, সেটা দেখা দরকার। এই লক্ষ্যে কেন্দ্র উদ্যোগী হচ্ছে।” কী সেই উদ্যোগ?
অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেছেন, “এ সব ক্ষেত্রে মামলা রুজুর সিদ্ধান্ত থানার ওসি নিতে পারবেন না। গ্রামাঞ্চলে তার অধিকার থাকবে শুধু ডিজি পদমর্যাদার কোনও পুলিশ অফিসারের হাতে। বড় শহরে আইজি পদমর্যাদার অফিসার ঠিক করবেন, তথ্য-প্রযুক্তি আইনে কারও বিরুদ্ধে মামলা করা হবে কি না।” আবেদনকারীর কৌঁসুলি মুকুল রোহতগির দাবি, “আইটি আইনের ৬৬এ ধারায় গ্রেফতার করার যে ক্ষমতা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে, তা পুরোপুরি অসাংবিধানিক। ধারাটাই বাতিল করে দেওয়া উচিত।”
এই মামলায় সামিল হতে চেয়ে বেশ ক’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে।
|
ধারা-বিচার |
|
তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারাটি কী?
• কম্পিউটার বা বৈদ্যুতিন সংযোগ দিয়ে আপত্তিকর বার্তা
(শব্দ, ছবি, লেখা) পাঠালে ৩ বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা |
|
আপত্তিকর বার্তা মানে কী?
• যা আতঙ্ক ছড়াতে পারে
• মিথ্যে জেনেও
অসদুদ্দেশ্যে পাঠানো
• যা প্রতারিত করতে পারে
• অন্যের নাম করে পাঠানো |
সুপ্রিম কোর্ট কী বলছে?
• ৬৬এ-র অপপ্রয়োগ রোধে কিছু করা
দরকার অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য
• ৬৬এ সংশোধন হচ্ছে
• মামলার সিদ্ধান্ত ওসি’র নয়
• সিদ্ধান্তের ভার ডিজি, আইজি’র |
আবেদনকারীর অভিযোগ
• এই ধারায় বাকস্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে
• পুলিশের হাতে গ্রেফতারের ক্ষমতা অসাংবিধানিক
• ৬৬এ বাতিল হোক |
|