থমকে গুচ্ছ কাজ
পড়ে বরাদ্দ টাকা, জল পেতে চাঁদা তুলছেন আদিবাসীরা
ভোটের আগে মদ পৌঁছে যায়। পৌঁছয় না তেষ্টার জল। এমনই অভিজ্ঞতা তালপুকুরিয়ার। গ্রামের অনিল সর্দার, সমীর সর্দারেরা বললেন, “যে দলই এলাকায় আসে আমাদের জলকষ্ট কমিয়ে দেবে বলে। কবে সে কষ্ট কমবে বলতে পারেন?”
বেলপাহাড়ি সদর থেকে ১৪-১৭ কিলোমিটার দূরের তালপুকুরিয়া, গাঁজুয়াম, কাশীজোড়া গ্রামগুলোর বেশির ভাগ টিউবওয়েলে জল ওঠে না। এখনই কুয়োর জল তলানিতে। গ্রীষ্মে জল আনতে যেতে হয় দূর-দূরান্তে। এই এলাকায় মাটির প্রায় ৫০০ ফুট নীচ থেকে ডিপ-টিউবওয়েলে সারা বছর জল সরবরাহের প্রকল্প ছিল পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের। বরাদ্দ ছিল টাকাও।
কিন্তু তেষ্টার জল আজও আসেনি গ্রামে। কারণ, পর্ষদের সঙ্গে বন দফতরের কাজিয়া।
২০১১-১২ অর্থবর্ষে পর্ষদ ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ করে জঙ্গল লাগোয়া ১৪০টি গ্রামের আড়াই লক্ষ বাসিন্দার উন্নয়নের জন্য। প্রকল্পের দায়িত্ব পায় ঝাড়গ্রাম বন বিভাগ। বেলপাহাড়ি, বিনপুর, ঝাড়গ্রাম, শিলদা, জামবনি ও গোপীবল্লভপুরের এই গ্রামগুলিতে পানীয় জল ও সেচের জন্য পাম্প হাউস-সহ ৫৭টি ডিপ-টিউবওয়েল, ৪০টি টিউবওয়েল, ৩৫ কিমি দীর্ঘ সেচনালা গড়ার পরিকল্পনা ছিল।
বন বিভাগের দাবি, তারা এখনও অবধি ১০ কোটি টাকার কাজ করেছে। কিন্তু বাকি টাকা আসেনি। তাই শেষ হওয়ার মুখে থমকে গিয়েছে এক গুচ্ছ কাজ। বকেয়া বন দফতর ও পর্ষদের মধ্যে চাপান-উতোর চলছে। পর্ষদের কর্তাদের বক্তব্য, হিসেব বুঝিয়ে দিলেই বাকি টাকা দেওয়া হবে। আর বন দফতরের কর্তা বলছেন, হিসেব বুঝিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও টাকা ছাড়ছে না পর্ষদ।
বেলপাহাড়ির তালপুকুরিয়া গ্রামে অসমাপ্ত জলপ্রকল্প। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
জলের তাগিদে গ্রামবাসীরা নিজেরাই সমাধান বার করছেন। বেলপাহাড়ির ভুলাভেদা পঞ্চায়েত। বাঁকুড়ার রানিবাঁধ ব্লক ঘেঁষা এলাকাটা কার্যত মাওবাদীদের ‘ধাত্রীভূমি’ বলে চিহ্নিত প্রশাসনের কাছে। সেখানেই এক গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে চালু করা হয়েছে অসমাপ্ত জল প্রকল্প। দিন আনি-দিন খাই মানুষগুলো মজুরির টাকা থেকে চাঁদা তুলে বসিয়েছেন জলের পাইপ, কল, পাম্প চালানোর যন্ত্রপাতি।
আদিবাসী প্রধান এই গ্রামটির ৪০ ঘর বাসিন্দার জলের জন্য ভরসা প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের একটা টিউবওয়েল। গরম পড়লে যেখানে রাত গভীর থেকে লাইন পড়ে। পর্ষদের প্রকল্পে বসেছে এক ডিপ-টিউবওয়েল। ট্যাঙ্ক, টাওয়ার, পাম্প-ঘর সবই তৈরি। চালু হয়নি বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে।
চলতি বছরের মে মাস নাগাদ প্রকল্প যখন থমকে গেল, গ্রামবাসী সিদ্ধান্ত নেন একটা ‘প্যানেল-বক্স’ বসিয়ে পাম্প চালু করবেন। সেই যন্ত্র কিনতে তিন হাজার টাকা, ছ’টা কল বসানো, পাড় বাঁধানোর জন্য ২৪ হাজার টাকা এবং প্রায় ২০০ ফুট পাইপ বসানোর জন্য আরও কিছু টাকা তাঁরা জোগাড় করেন চাঁদা তুলে। তারপর ঝুঁকি নিয়েই ব্যবস্থা হয় অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের।
গ্রামবাসী যুবকদের কথায়, “একশো দিনের প্রকল্পের দিনমজুরি থেকে টাকা বাঁচিয়ে চাঁদা দিয়েছে লোকে। অগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে জল পাচ্ছি। দিন-রাত মিলিয়ে ঘণ্টা দেড়েক পাম্প চালালেই ট্যাঙ্ক ভর্তি। তবে এখনও গ্রামের সর্বত্র কল বসাতে পারিনি।” তাঁরা দাবি করলেন প্রকল্পের জন্য বিদ্যুৎ বণ্টন দফতরের কাছে আগাম আবেদনও জানিয়ে রেখেছেন। জবাব মেলেনি। তবে বিদ্যুৎ বণ্টন দফতর জানিয়েছে, তারা ওই গ্রামের আবেদন পায়নি। বিনপুরের সিপিএম বিধায়ক দিবাকর হাঁসদার অভিযোগ, “সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক পক্ষপাত। জল না পেয়ে মানুষ আইন ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। অসন্তোষও বাড়ছে।”
এ চিত্র কেবল এই গ্রামেরই নয়। বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভানেত্রী ঝাড়খণ্ড পার্টির (নরেন) সোমবারি সোরেন বলেন, “ওই গ্রামের মতো আমার গ্রাম গাঁজুয়াম-এও ওই প্রকল্প অসমাপ্ত। তবে আমরা বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ নেওয়ার পথে হাঁটিনি। তবে ওদের সমস্যার কথা উপর মহলে জানিয়েছি।”
কেন টাকার অভাবে আটকে রয়েছে পানীয় জলের প্রকল্প?
পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমার হাঁসদা জানান, পশ্চিম মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ার বন বিভাগগুলিকে বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা দিয়েছিল পর্ষদ। তারা প্রকল্পের ছবি-সহ খরচের বিশদ হিসেব বুঝিয়ে দিয়েছে। মন্ত্রীর দাবি, ঝাড়গ্রামের ডিএফও তা দেননি। “হিসেব বুঝিয়ে দিলে বাকি টাকা দিয়ে দেওয়া হবে,” বলেন তিনি।
ঝাড়গ্রামের ডিএফও অশোকপ্রতাপ সিংহ মন্তব্য করেননি। তবে পর্ষদের সঙ্গে বন দফতরের এই টানাপোড়েনের খবর পেয়ে প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়েছিলেন রাজ্যের বিশেষ মুখ্য বনপাল এন ভি রাজাশেখর। রাজাশেখরের দাবি, পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ যেমন চেয়েছে, ঝাড়গ্রাম বন বিভাগ তেমনই বিশদ রিপোর্ট দিয়েছে। বন দফতরের একাধিক কর্তার বক্তব্য, পর্ষদ কেন বকেয়া টাকা ছাড়ছে না, স্পষ্ট নয়।
এই চাপান-উতোরের বাইরে গ্রামবাসী কেবল তেষ্টার জলটুকুর জন্য পাম্প চালাতে বাধ্য হচ্ছেন হুকিং করে। তাঁদের যুক্তি, “আগে জল খেয়ে বাঁচি। সরকার প্রশ্ন করতে এলে জানতে চাইব, কেন আইন ভাঙতে বাধ্য করা হল আমাদের!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.