সাড়ে তিন বছর আগে এলটিটিই-র গেরিলাদের নিশ্চিহ্ন করার ব্রতটি শ্রীলঙ্কার মহিন্দ রাজাপক্ষ সরকার সম্পূর্ণ করিয়াছে। কিন্তু তামিলদের সহিত সিংহলিদের জাতিবৈর বিন্দুমাত্র প্রশমিত হয় নাই। তামিলরা এই দ্বীপরাষ্ট্রে এখনও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তাঁহাদের উপর নজরদারি চালানো হয়, তাঁহাদের গতিবিধির উপর অতন্দ্র দৃষ্টি রাখা হয়। তামিল গরিষ্ঠতার অঞ্চল জাফ্নাতেও কার্যত তামিলরা সিংহলি সেনা ও পুলিশের সজাগ নজরদারির শিকার। এই পরিস্থিতি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনও সৌহার্দ্য বা সম্প্রীতির সেতু রচনায় সহায়ক নয়, বরং ইহা পারস্পরিক সন্দেহ ও বিরূপতাকেই বাড়াইয়া তোলে। জাফ্না বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক তাহাই ঘটিয়াছে। তামিল ছাত্রদের একটি অনুষ্ঠানে আপত্তি জানাইতে গিয়া সিংহলি সেনারা নিরস্ত্র পড়ুয়াদের উপর হামলা চালাইয়া কুড়ি জনকে আহত করিয়াছে, যাহাদের মধ্যে সাত জনের আঘাত গুরুতর।
স্বভাবতই এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হইয়াছে। সিংহলি সেনারা জাফ্না বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে কী করিতেছিল, কে-ই বা তাহাদের বিদ্যায়তনে প্রবেশাধিকার দেয়, ছাত্রদের উপর চড়াও হওয়ার নির্দেশই বা কোথা হইতে আসিল প্রশ্নগুলি উঠিতেছে। ক্ষুব্ধ তামিলরা দাবি করিতেছেন, সেনাবাহিনী ছাউনিতে ফিরিয়া যাক, তাহাদের জনসমাজে কোনও কাজ নাই। এমনিতেও সেনারা ব্যারাকে থাকিবে, ইহাই দস্তুর। সব জানিয়া-বুঝিয়াই কি ইচ্ছাকৃত ভাবে উত্তেজনাপ্রবণ এই পরিস্থিতি তৈয়ার রাখা হইয়াছে, যাহাতে সামান্য প্ররোচনাতেই অসামরিক তামিল জনতার উপর সিংহলি সেনা-পুলিশ ঝাঁপাইয়া পড়িতে পারে, দমন-পীড়ন চালাইতে পারে। এই দমননীতির লক্ষ্য যে সংখ্যালঘু তামিলদের দ্বীপভূমিতে ভবিষ্যতে আর কখনওই শিরদাঁড়া সোজা করিয়া দাঁড়াইতে না-দেওয়া, তাহা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এ জন্যই জাফ্না প্রদেশকে সেনামুক্ত করার যে প্রস্তাব রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে দেওয়া হয়, রাজাপক্ষ সরকার তাহাতে কর্ণপাত করে নাই।
তামিলদের সমানাধিকারের দাবি উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা রাজাপক্ষ পরিবার কখনওই শিরোধার্য করিবে না। তবে সংখ্যালঘু-পীড়নই এই স্বৈরাচারীদের একমাত্র বর্বরতা নয়। ইহা হইল পারিবারিক স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান, যাহার মাধ্যমে সমগ্র সিংহলি জনগোষ্ঠীর কাছ হইতে শাসন চালাইবার বৈধতা আদায় করিয়া লওয়া যায়। এই সোপানের উপর দাঁড়াইয়াই রাজাপক্ষ পরিবারের পরবর্তী পদক্ষেপ: বিচারব্যবস্থাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনিতে উদ্যত হইয়াছে। দেশের প্রধান বিচারপতি শিরানি বন্দরনায়েককে অপসারণ করিতে তাঁহার বিরুদ্ধে ‘ইম্পিচমেন্ট-প্রস্তাব’ আনার এই স্বৈরাচারী উদ্যোগকে দ্বীপরাষ্ট্রের সব কয়টি থেরবাদী বৌদ্ধ গোষ্ঠীর পুরোহিতদের সংগঠন ‘মহানায়ক থেরো’ রদ করার আহ্বান জানাইয়াছে। তবে যাঁহারা আপত্তির কণ্ঠ তুলিতেছেন, সম্ভবত তাঁহারা অনেকেই শ্রীলঙ্কার সমাজ হইতে ক্রমশ অদৃশ্য হইয়া যাইবেন! পক প্রণালীর অপর প্রান্তের গণতন্ত্র এমনই স্বৈরাচারের পরাকাষ্ঠা রচনা করিয়া চলিয়াছে। |