দরিদ্রের জন্য নানা প্রকল্পে সরকারের অনুদানের অর্থমূল্য সরাসরি গরিব পরিবারগুলির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠাইবার ব্যবস্থা প্রায় পাকা হইয়া আসিয়াছে। আগামী বৎসরের গোড়াতেই ‘আধার’ কার্ডের ভিত্তিতে দেশের নানা অঞ্চলে গরিবের হাতে টাকা পৌঁছাইয়া যাইবে, এমন ঘোষণা সম্প্রতি করিয়াছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী চিদম্বরম। আপাতত সমাজকল্যাণমূলক ৪২টি সরকারি প্রকল্পের ২৯টি অর্থমূল্য প্রদানের আওতায় আসিতেছে। এই পরিকল্পনা নূতন নহে। ইহার ভাল-মন্দ লইয়া বহু বিতর্কও হইয়া গিয়াছে। বিশেষত রেশনের চাল-গম সরাসরি গরিবকে না দিয়া, তাহার অর্থমূল্য পাঠাইলে গরিব পরিবারগুলির অপুষ্টির হারের উপর তাহার কী প্রভাব পড়িবে, তাহা লইয়া বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও বহু মতভেদ হইয়াছে। বামপন্থী দলগুলি এখনও অর্থমূল্য প্রদানের বিরোধী। কিন্তু এই ব্যবস্থার সুবিধাও কম নহে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, দরিদ্রকে প্রদেয় ভর্তুকির কালোবাজারি প্রায় একটি বিকল্প জীবিকা হইয়া দাঁড়াইয়াছে বহু মানুষের কাছে। বহু বৎসর ধরিয়া সেই চোরাবালির বাঁধে তলাইয়া গিয়াছে গরিবের প্রাপ্যের সিংহভাগ। অতি সামান্যই শেষ অবধি তাহার হাতে আসিয়াছে। তৎসহ জুটিয়াছে নানা অসম্মান, হয়রানি। অপর দিকে, অনুদান প্রাপ্তির নানা শর্ত তৈরি করিয়া গরিব মানুষগুলির থেকে কখনও উৎকোচ, কখনও রাজনৈতিক আনুগত্য আদায় করা হইয়াছে। অনুদানের অর্থমূল্য সরাসরি হাতে আসিলে এই সকল সমস্যা অনেকটাই লাঘব হইবে, সন্দেহ নাই। তৎসহ আরও একটি সুবিধা হইবে। উন্নয়ন বিষয়ক গবেষণার ফল হইতে নানা অর্থনীতিবিদ দেখাইয়াছেন, গরিবদেরও রহিয়াছে নিজস্ব প্রয়োজন এবং পছন্দ। সরকারি প্রকল্পের দান গরিবের নিজস্ব চাহিদার সহিত না মিলিলে তাহা নষ্টই হয়, গরিবের কাজে আসে না। অর্থমূল্য দিলে প্রয়োজন অনুসারে ব্যয় করিবার সুযোগ অধিক। ইহাতে অপব্যয়ই হইবে, এমন আশঙ্কা করা ঠিক নহে। যথাযথ ব্যয় বাড়িবে, এমন সম্ভাবনাও রহিয়াছে যথেষ্ট।
অতএব অনুদানের অর্থমূল্য দিবার প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করিবার পরিবর্তে তাহাকে স্বাগত জানানো প্রয়োজন। কিন্তু সেই স্বাগতবার্তা শর্তহীন অনুমোদন নহে। বরং সতর্কবার্তারও প্রয়োজন রহিয়াছে। ভারত একটি বিশাল, জনবহুল দেশ। বারবার দেখা গিয়াছে, কোনও একটি নতুন প্রকল্প একই সঙ্গে গোটা দেশে শুরু করিলে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। ইহার কিছুটা প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রস্তুত না থাকিবার কারণে। কিন্তু অনেকটাই এই কারণে যে, নানা প্রদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন বলিয়া, একই প্রকল্পের ছাঁচে সেগুলি আঁটিতে চাহে না। প্রকল্প একবার চালু হইয়া গেলে তাহার পরিকাঠামোয় সংশোধন আনিবার সুযোগ কম। তাই সামান্য রদবদল করিলেই যেখানে চাহিদা পূরণ হইতে পারিত, সেখানে চাহিদার সহিত সমাধানের ব্যবধান বাড়িতেই থাকে। ইউ পি এ সরকার এ ক্ষেত্রেও ২০১৩ সালের মধ্যে সমগ্র দেশে অনুদানের অর্থ ব্যাঙ্কে পাঠাইবার পদ্ধতি চালু করিয়া ২০১৪ সালের নির্বাচনের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাকে গুরুত্ব দিতেছে, গরিবের প্রয়োজনকে নহে, এই সন্দেহ অস্বাভাবিক নহে। বিশেষত দেশের বহু রাজ্যে যেখানে সর্বত্র আধার কার্ড প্রস্তুত হয় নাই, সেখানে বিভ্রান্তির সুযোগ রহিয়াই যাইতেছে। আপত্তি আরও এই কারণে যে, রাজ্য সরকারগুলিকে অনুদান বিতরণের পদ্ধতি স্বাধীন ভাবে নির্বাচন করিতে দিলেই যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর মর্যাদারক্ষা হইত। তাহা না করিয়া কেন্দ্রীয় সরকার একক ভাবে সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি বিতরণের পদ্ধতি ঘোষণা করিল।
অপর একটি সমস্যা অবশ্যই দরিদ্রের ব্যাঙ্ক সংযুক্তির স্বল্পতায়। একশো দিনের কাজের মজুরির টাকা পাইতে দরিদ্রের কতখানি হয়রানি হইয়া থাকে, তাহা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। ডাকঘর কিংবা গ্রামীণ ব্যাঙ্কে গরিব মানুষেরা অ্যাকাউন্ট খুলিলেই সমস্যার শেষ হয় না। সামান্য কর্মী, সামান্য পরিকাঠামোর ফলে এক দিনে ২০ জন কিংবা ৩০ জনের অধিক গ্রাহককে মজুরির টাকা দেওয়া হইবে না, এমন শর্তও করে ডাকঘর কিংবা ব্যাঙ্কগুলি। উপর হইতে যাহা ‘আর্থিক সংযুক্তি,’ নীচের স্তরে তাহাই চরম দুর্ভোগ। অতএব প্রাপকের নিকট টাকা কী রূপে, কী শর্তে পৌঁছাইবে, এই নূতন ব্যবস্থাতেও তাহার প্রতি নজরদারি রাখিতেই হইবে। |