চেক দেশ দেখে ফেলেছে মাস চারেক আগেই। কলকাতা এই সবে দেখল। এ দেখাই শেষ দেখা কি না, কেউ জানে না।
নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে ডিজিটাল ক্যামেরায় সত্তর মিনিটের যে ছবি বানিয়েছেন কলকাতার সুব্রত আচার্য, চেক রিপাবলিকের কার্লোভি ভ্যারি চলচ্চিত্রোৎসবে এ বছর সেটিই ছিল এক মাত্র ভারতীয় ছবি। ছবির নাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে ধার করা ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। ‘অ্যানাদার ভিউ’ বিভাগে সে ছবি দেখিয়ে উৎসবের অন্যতম কর্তা কারেল ওচে-র মন্তব্য, “ভারত থেকে এই নতুন স্বরকে পেয়ে আমরা অবাক এবং আহ্লাদিত।”
কলকাতার একটি প্রেক্ষাগৃহে বন্ধু ও আমন্ত্রিতদের মধ্যে সম্প্রতি ঘরোয়া ভাবে দেখানো হল সেই ছবি। আমজনতা দেখবে কবে? সুব্রত জানেন না।
যেমন জানেন না বিক্রমজিৎ গুপ্তও। একটা ধ্যাড়ধেড়ে অরিফ্লেক্স ১৬ মিমি ক্যামেরায় চার বছর ধরে ক’টি হাড়-হাভাতে মানুষের জীবনগাথা রচনা করেছেন বিক্রম। গল্পের কেন্দ্রে এমন এক মানুষ, যিনি মুখে রং মেখে অচেনা ভিড়ে নেতাজি, গাঁধী, কার্ল মার্ক্স সেজে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর প্রেমে পড়েন ঝলমলে বিপণির কাচের আড়ালে দাঁড়ানো অচল ম্যানিকুইনের! দিল্লিতে ওশিয়ান্স সিনেফ্যান ফেস্টিভাল আর বিদেশের কিছু উৎসবে ঘুরে আসার পরে সদ্য সিনে সেন্ট্রালের উৎসবে দেখা গিয়েছে সেই ছবি, ‘অচল’। চিত্রগ্রাহক অমিত মজুমদার হাসেন, “একটু করে টাকা জোগাড় হয়েছে, দু’তিন মিনিট শ্যুট করার মতো ফিল্ম কেনা হয়েছে। এই করেই চার বছর!”
কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সিজার দাস হাজির হয়েছিলেন তাঁর প্রথম ছবি ‘আনটাইটলড্’ নিয়ে। সেই ছবিও এক শুভানুধ্যায়ীর টাকায় তৈরি। কিন্তু তার পর? সে ছবি দর্শকের দরবারে পৌঁছবে কী করে, সেটা নিয়েই প্রশ্ন।
কাগজে-টিভিতে বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে রাজ্য জুড়ে বাছাই করা প্রেক্ষাগৃহে ছবির পরিবেশনা, সব কিছুর জন্যই খরচ আছে। ছবির প্রদর্শন ও পরিবেশনায় অঙ্গাঙ্গী জড়িত প্রিয়া এন্টারটেনমেন্টসের কর্ণধার অরিজিৎ দত্তের কথায়, “এখন ছবি তৈরির জন্য বিশ টাকা খরচ হলে আশি যায় এই সবে। তা জোগাতে না পারলে ছবি মুক্তি পাবে কী করে?” |
এই ধাপটায় আটকে বিক্রমজিৎরা হতাশ “ছবিটাই তো শেষ করতে পারছিলাম না। চূড়ান্ত পর্যায়ে মুম্বইয়ের এক জন কিছু টাকা দিয়েছিলেন। আর পাব কোথায়?” যা শুনে প্রযোজক-পরিবেশক শ্রীভেঙ্কটেশ ফিল্মসের অন্যতম কর্তা মহেন্দ্র সোনি বললেন, “যে ছবি দেখতে দর্শকেরা হলে আসবেন, তার জন্য আমাদের দরজা খোলা আছে। সেই ছবির প্রযোজক-পরিচালকের যদি টাকা না-ও থাকে, আমরা এগিয়ে যেতে পারি।”
আর যে ছবি দর্শকের রুচি মেনে তৈরি নয়? মহেন্দ্রর মতে, “সে সব ফেস্টিভালে দেখানো যেতে পারে, টিভি স্বত্ত্ব বিক্রি করে বা ইন্টারনেটে আপলোড করেও কিছু টাকা আসতে পারে। কিন্তু হলে রিলিজ সম্ভব নয়।” সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মনে করিয়ে দেন, “পথের পাঁচালী হওয়ার পরে সেনেট হলের সংবর্ধনায় সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, দর্শক দেখবে বলেই তিনি ছবি করেন। বক্স অফিস সম্পর্কে তাঁর ধারণাটা একটু আলাদা, এই যা।” কিন্তু হল-ই না পেলে দর্শক দেখবে কী করে? সৌমিত্রের মতে, “এত দিন যাঁরা ছবি করে এসেছেন, তাঁরা এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই করেছেন।”
প্রযোজক-স্টুডিও-পরিবেশকের চেনা বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের জমানো টাকা, আত্মীয়স্বজনের স্নেহের দান, বন্ধুবান্ধবের জড়ো করা টাকায় যুগে যুগেই ছবি তৈরি হয়েছে। বিদেশে তো বটেই, এ বঙ্গেও। সরাসরি জনতার থেকে পয়সা তুলে তৈরি হয়েছিল ঋত্বিক ঘটকের প্রথম ছবি ‘নাগরিক’। নিজের প্রায় সর্বস্ব দিয়ে ‘পথের পাঁচালী’ করতে গিয়ে তিন বছর ধরে নানা অসুবিধার পরে বাধ্য হয়েই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে দ্বারস্থ হন সত্যজিৎ। এর-ওর থেকে চেয়েচিন্তে পার্থপ্রতিম চৌধুরী তৈরি করেন ‘যদুবংশ’।
এ রকম চেষ্টা আরও হয়েছে। কিছু চলেছে, কিছু চলেনি। একটা বড় অংশ প্রেক্ষাগৃহের সাদা পর্দা পর্যন্ত পৌঁছতেই পারেনি। আশির দশকের শেষে ‘কাল অভিরতি’ তৈরি করেছিলেন পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে সম্পাদনা শিখে আসা অমিতাভ চক্রবর্তী। জাতীয় পুরস্কার জিতেও তা হলের মুখ দেখেনি। সেই অমিতাভই ফের নিজের পয়সায় বানিয়েছেন ‘কসমিক সেক্স’। ওশিয়ান্স ঘুরে তা-ও পৌঁছেছে সিনে সেন্ট্রালের উৎসবে। কিন্তু হলে মুক্তি পাওয়ার জন্য সেন্সরের ছাড়পত্র কি মিলবে? অমিতাভর কথায়, “ওরা যদি আটকায়, ডিভিডি করে বাজারে ছাড়ব। দেশ-বিদেশের উৎসবে দেখিয়ে বেড়াব।” কৌশিক মুখোপাধ্যায়ের (কিউ) ‘গান্ডু’ও নিজের খরচে তোলা। কিউ তা সেন্সর করিয়ে রিলিজ করার চেষ্টাই করেননি। বরং দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্রোৎসব এবং ইন্টারনেট লিঙ্কের দৌলতেই বাজার মাত করে দিয়েছেন। পরের ছবি, অনুরাগ কাশ্যপের সহ-প্রযোজনায় বানানো ‘তাসের দেশ’ রোমে দেখিয়েও ফেলেছেন। উৎসব, ডিভিডি আর ইন্টারনেট নয়া জমানার স্বাধীন ছবির তিন প্রধান অবলম্বন। অনুরাগ কাশ্যপ বা ওনির বা বেদব্রত পাইন-এর মতো করে এখনও ছবির পরিবেশক জোগাড় করতে পারেননি যাঁরা, তাঁরা এই তিনটি পথই নিচ্ছেন মূলত। এই রাস্তায় হাঁটতে চাইছেন সুব্রতও, “এখানে আমার ছবি দেখাতে পারব বলে মনে হয় না। বিদেশের ফেস্টিভালের মুখ চেয়েই বাঁচতে হবে।” যে পরিচালকেরা ইদানীং নাগরিক বাংলা ছবিতে তাজা হাওয়া এনেছেন, তাঁদের অন্যতম অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী আশাবাদী, “ভাল ছবিকে বেশি দিন আটকে রাখা যায় না। এ রকম ছবি হতে থাকলে পরিস্থিতিটাও ধীরে ধীরে পাল্টাবে।”
সরকার চাইলে নন্দন বা স্টার থিয়েটারের মতো হাতে গোনা কিছু হলে ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারে। বহু ক্ষেত্রেই স্বাধীন চলচ্চিত্রকারদের একটা ভরসার জায়গা, নন্দন। কিন্তু সেটা যে যথেষ্ট নয়, সে বিষয়ে সকলেই একমত। তা হলে কী ভাবে অবস্থা বদলাতে পারে? পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “বিদেশে এ ধরনের ছবি দেখানোর ব্যবস্থা আছে। স্বাধীন চলচ্চিত্রকারদের উচিত জোট বেঁধে সরকারকে চাপ দেওয়া। অন্তত উত্তর, মধ্য, দক্ষিণ কলকাতা আর শহরতলির কোনও মাল্টিপ্লেক্সে এই ধরনের ছবি দেখানোর ব্যবস্থা হোক।” |