মুখোমুখি...
‘দুনিয়ার সব চেয়ে বড় রোগ ক্যানসার নয়
লোকে আমার সম্পর্কে কী ভাবছে ভীতি’

পত্রিকা: ‘বিগ বস’ থেকে আপনার বেরিয়ে আসা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। নিতিন গড়কড়ির নির্দেশ-টির্দেশ। সেগুলোতে আর ঢুকছি না।

সিধু: ওকে।

পত্রিকা: কিন্তু অবাক হয়ে জানতে চাইছি আপনি হঠাৎ ‘বিগ বস’য়ে যেতে রাজি হয়েছিলেন কী করে? প্রচুর টাকা দিয়েছে?
সিধু: আই চার্জড দেম আ বম্ব। কোনও সন্দেহ নেই। সিধু সস্তায় পাওয়া যায় না। কিন্তু টাকা ছাড়াও ‘বিগ বস’য়ে একটা চ্যালেঞ্জের মাদকতা ছিল।

পত্রিকা: কীসের চ্যালেঞ্জ? ডিজাইনার সেটে বসে ক্যামেরার সামনে দিনের পর দিন ছবি তোলা। ‘বিগ বস’ থোড়াই বার্বেডোজে গিয়ে মার্শালকে খেলা!
সিধু: কী বলছেন ভাই (বেশ উত্তেজিত)! আপনার মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? বিগ বস আমার মতে দুনিয়ার কঠিনতম শো। পাগল হয়ে যাবেন মশাই ওই ঘরে ঢুকলে। টানা তিনটে মাস ওখানে কোনও খবরের কাগজ নেই, ফোন নেই, নিজের মর্জিমতো যখন খুশি খাওয়ার অধিকার নেই, টিভি নেই, রেডিও নেই, বাইরের সভ্যতাই নেই। মুখের ওপর ক্যামেরা আর সঙ্গে কিছু লোক যাঁদের অর্ধেককেই আপনি চেনেন না। মনের ওপর যে কী বিরামহীন চাপ পড়ে বলে বোঝাতে পারব না। ওই চাপ আর আপনার নিজের বিপন্নতা থেকেই খারাপ জিনিসগুলো বেরিয়ে আসে। মানুষকে মনে হতে থাকে অমানুষ। আমার তো চাপে-পরিস্থিতিতে-কঠিনতম ওই শৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে কান ঝাঁ-ঝাঁ করত। তা-ও নিজেকে হারিয়ে ফেলিনি। হারিয়ে না ফেলাটাই আমার সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
পত্রিকা: তাই?
সিধু: অ্যাবসলিউটলি! আমার মেয়ে শো-তে যাওয়ার আগে সতর্ক করে দিয়েছিল। শো থেকে বেরিয়ে আসার পর খুব গর্বিত ভাবে বলল, ড্যাডি করে দেখিয়েছ! আমায় বলুন না... ‘বিগ বস’য়ে গিয়ে নিজের ইমেজ খুইয়ে বসেনি এমন একটাও নাম বলতে পারেন কি না। একমাত্র নভজ্যোৎ সিংহ সিধু।

পত্রিকা: টাকাটা কী হল? তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসায় অ্যাডজাস্ট করতে হল?
সিধু: ও তো নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়েই যায়।

পত্রিকা: কপিল দেব কিছু দিন আগে বলেছেন, সিধুটা ক্রিকেটার জীবন ব্যাকফুটে ছিল। কথাই প্রায় বলত না। খেলা ছাড়ার পর কী ভয়ঙ্কর ফ্রন্টফুট খেলছে। পিছনের পায়ে আর যায়ই না।
সিধু: আঃ কপিল পাজি। দুর্ধর্ষ একটা লোক। স্ট্রিট-স্মার্ট। পাজিকে নিয়ে তা হলে একটা গল্প শুনুন। আমদাবাদেই তিরাশিতে আমার জীবনের প্রথম টেস্ট। পাজি তখন আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো আগলে আগলে রাখে। টেস্টের মধ্যে রেস্ট ডে হত তখনকার দিনে। তো সে দিন পাজিকে নিয়ে ভীষণ হইচই হচ্ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ন’টা উইকেট নিয়েছে আগের দিন। প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছে ওর জন্য। শুধুই বিদেশি সাংবাদিক। ব্রিটিশ, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, আরও অনেকে। আমি তখন ভাবছি, পাজি কী অসমসাহসী রে বাবা। ইংরেজির সীমাবদ্ধতা নিয়েও এখানে চলে এসেছে। আর কী সব অ্যাকসেন্টে প্রশ্ন করছে জার্নালিস্টরা। সারা জীবন ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেও আমি রীতিমতো কাঁপছি। প্রশ্নগুলোর মূল বক্তব্য: কপিল, এক দিক থেকে আপনিই ন’টা উইকেট নিচ্ছেন। অন্য প্রান্ত থেকে কোনও সাপোর্ট নেই কেন? কবে ভারত পরের কপিল দেব প্রসব করবে? কপিল-পাজি মন দিয়ে প্রশ্নগুলো শুনল। তারপর গলাটা কেশে ওর অননুকরণীয় অ্যাকসেন্টে শুরু করল, লে-দি-জ অ্যা-ন্ড জে-ন্ড-ল-মা-ন। কেন লেডিজ বলেছিল কে জানে! ঘরে আমি তো কোনও মহিলা দেখতে পাইনি। যাক পাজি বলল, “আপনারা ভাল করে শুনে নিন। আমার বাবা পরপারে চলে গিয়েছেন। আমার মায়ের বয়স বাষট্টি। দ্বিতীয় কপিল দেব আর প্রসব হবে না।”
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। ঘটনাটার কথা ভাবলে আমার এখনও হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। জার্নালিস্টদের মুখগুলো দেখার মতো ছিল। হাঃ হাঃ হাঃ।

পত্রিকা: দুর্ধর্ষ গল্প। কিন্তু কপিলের অরিজিন্যাল পর্যবেক্ষণটা সকলের মনের কথা। এই উচ্ছল সিধুকে ক্রিকেটার সমাজ মোটেও চিনত না।
সিধু: দেখুন ভাই আমি একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করতে পারি না। একটাই করি আর মন দিয়ে করি। ক্রিকেট যখন খেলতাম তখন ওটাই ছিল প্যাশন। ওটাই মন দিয়ে খেলেছি। বাকি কিছু ভাবিনি। এর পর টিভিতে যখন এলাম, শুধুই টিভি। রাজনীতিতে গেছি, সেটা মন দিয়ে করেছি। আবার এখন এই সিরিজের কমেন্ট্রি দিচ্ছি। এখন পার্লামেন্টের কথা ভাবছিই না। প্রত্যেকটা ভূমিকাতেই আমি সফল। কারণ প্যাশনের সঙ্গে আমি কখনও তঞ্চকতা করিনি। প্যাশনের পিঠে আবার অন্য কোনও লক্ষ্যকে তুলে দিইনি। জুনুন বোঝেন? জুনুন! সিধু সাকসেসফুল হয় কারণ সিধু জুনুনকে ধ্রুবতারা করে জীবনে এগোয়। আমার জীবন একটা ঢেউয়ের মতো। সেই ঢেউয়ের মাথার মণি হল জুনুন। যাকে আশ্রয় করে আমি সাঁতরেছি।
সর্দার নম্বর দিলেন
আজহার
সৌরভ
ধোনি
পত্রিকা: কিন্তু এই যে বলার দীপ্তি। অনর্গল কথা বলা। শরীরের তেজ। ক্রিকেটার সিধুর যতই জুনুন থাক, তার তো এই শরীরী ভাষাই ছিল না।
সিধু: ঠিক কথা। আমার জীবন বদলে দিয়েছে ১৯৯৯ সালে পড়া একটা বই। পড়ার পর থেকে মানুষ হিসেবে আমি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত।

পত্রিকা: বই পড়ে? কী বই?
সিধু: ‘দ্য কমপ্লিট ওয়ার্কস অব স্বামী বিবেকানন্দ’। ওই একটা বই আমার জীবনের গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়েছে।

পত্রিকা: অনেকগুলো খণ্ড আছে তো। কোনটা?
সিধু: লাস্ট ভলিউম। ওটা পড়ে ফেলার পর আর জীবনে কিছু চাই না। দ্য আল্টিমেট।

ছবি: উৎপল সরকার
পত্রিকা: বাকিগুলো পরবর্তী কালে পড়েছেন?
সিধু: না। ওই একটা বই থেকেই আমার যা রসদ দরকার ছিল পেয়ে গিয়েছি। সিধুর রূপান্তর ঘটে গিয়েছে।

পত্রিকা: কী ভাবে?
সিধু: আমি বুঝতে শিখেছি মনটাই সব। মনই জীবনের জ্বালানি। আর তার মধ্যে কোনও সংশয় রাখতে নেই। সেটা হবে নির্ভীক। স্বাধীন। আজ আমার মধ্যে নিজেকে নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কোনও মৃত্যুভয় নেই। বাকি পৃথিবী আমাকে কী চোখে দেখল তা নিয়ে কোনও দুর্ভাবনা নেই। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যাধি কী জানেন?

পত্রিকা: ক্যানসার।
সিধু: না, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অসুখ হল লোকে আমাকে নিয়ে কী ভাবছে সেই ভীতি। ওটা কাটিয়ে উঠতে পারলে দেখবেন জীবনের একটা অন্য মানে এসে গেছে।

পত্রিকা: বেলুড় মঠ গেছেন? বা দক্ষিণেশ্বর?
সিধু: হ্যাঁ। দক্ষিণেশ্বর তো আমার তিন-চার বার ঘোরা। রামকৃষ্ণের যে ঘর আছে ওখানে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে এসেছি।

পত্রিকা: এ বার ইডেন টেস্টের সময় আবার যাবেন?
সিধু: ঠিক করিনি। আসল উপকার কিন্তু ওই জায়গাগুলো দর্শনের মধ্যে লুকিয়ে নেই। আসল হলনিজের মনকে নিজে জানা। তাকে তৈরি করা। মনই আপনার সামনে কাঁটার পাহাড় সাজিয়ে দিতে পারে। আবার মনই সেই গিরিশৃঙ্গের ওপরে আপনার অধিষ্ঠান দেখাতে পারে। যদি সত্যিই আপনি সেটার ওপর চড়তে চান। ওই বইটা পড়ার পর আমি নিজের মনের মধ্যে ডুব দিতে শিখেছি। নিজের ভেতরটা নিজেই আমি এখন পরিষ্কার দেখতে পাই। ভেতরটা কেমন টলটল করছে টের পাই। এটাই তো সব চেয়ে বড় শক্তি। মনের ডার্ক-রুমেই যাবতীয় সংশয়ের নেগেটিভ তৈরি হয়। আমার মনের মধ্যে তাই ডার্ক-রুমটাই বিদায় নিয়েছে।

পত্রিকা: মনে করা যাক ১৯৮৩ সালে টেস্ট অভ্যুদয়ের আগে স্বামীজির বইটা কেউ আপনাকে উপহার দিল। কোনও বদল হত?
সিধু: বদল হত মানে? কী বলছেন! ১৫ সেঞ্চুরি আছে আমার। ওটা অন্তত গিয়ে দাঁড়াত ৪০ সেঞ্চুরিতে!

পত্রিকা: ১৯৯৬-তে ইংল্যান্ড সফরের মাঝপথে হঠাৎ করে নিজে থেকে ফেরত চলে এসেছিলেন আপনি। সৌরভের যেটা প্রথম সিরিজ। বইটা পড়া থাকলে নজিরবিহীন সেই প্রত্যাবর্তন ঘটত?
সিধু: ঘটত। আজও ফিরে আসতাম। ব্যক্তিগত মর্যাদায় ঘা লাগলে আপনাকে পদক্ষেপ করতেই হবে। তার সঙ্গে কোনও আপস নেই।

পত্রিকা: কে ঘা দিয়েছিল ব্যক্তিগত মর্যাদায়?
সিধু: বলা যাবে না। সংসারের নোংরা কেচ্ছা আমি বাইরে আনব না।

পত্রিকা: সে তো তখন আনেননি। তার পর তো ষোলো বছর হয়ে গিয়েছে। গঙ্গা আর টেমস দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে।
সিধু: যত জলই গড়াক। সংসারের গুপ্ত কথা গুপ্ত কথাই থাকে। কাউকে বলিনি। বোর্ড কর্তাদেরও না।

পত্রিকা: সে দিনের ক্যাপ্টেন মহম্মদ আজহারউদ্দিনের সঙ্গে আজকের দিনে আপনার কী সম্পর্ক? পার্লামেন্টে দেখা হয়?
সিধু: খুব ভাল। আজহার আজও আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখে। এই তো একটা সভায় ওকে বলা হল, আজহারজি ছক্কা মারকে দিখাইয়ে। আজহার বলল, ছক্কা তো মেরা দোস্ত মারতা থা। সিধু।

পত্রিকা: আজহারের ক্রিকেট ভাবমূর্তির নরকযাত্রা সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?
সিধু: আমার অভিমত, আজহার একজন ফ্যান্টাস্টিক ক্রিকেটার হয়েও বেচারি দুর্ভাগা। প্রাপ্য সম্মান পায়নি।

পত্রিকা: গড়াপেটায় শাস্তি পাওয়া মানুষ কী করে সম্মান পাবেন?
সিধু: আপনি দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কিন্তু আপনি দোষী নন। মনে রাখবেন আজহারকে শাস্তি দিয়েছে বোর্ড। আদালতে কিন্তু আজহারই মামলা জিতেছে।

পত্রিকা: সবাই তো জানে সত্যিটা কী। আপনি টিমে খেলতেন। আপনি জানেন না?
সিধু: না। আমি মনে করি ম্যাচ গড়াপেটার জন্য সুনির্দিষ্ট কড়া আইন থাকা দরকার। দেশদ্রোহিতার যে সেকশনে বিচার হয় এটারও তাই হোক। কিন্তু আইন না থাকলে অপরাধ আটকানো যাবে না।

পত্রিকা: আজহারকে ক্যাপ্টেন হিসেবে দশে কত দেবেন?
সিধু: উঁ হু হু। ছয়।

পত্রিকা: গাওস্কর আর সচিন দুটো জমানাতেই আপনি খেলেছেন। কোনটা বেশি প্রিয়?
সিধু: আমি তিনটে জমানায় খেলেছি। সৌরভ-রাহুলদেরটাও যোগ করুন। আমার সবচেয়ে প্রিয় তিন নম্বর জমানা। টিমটা তখন অনেক কাছাকাছি এল। তার আগে সিনিয়র থাকত সিনিয়রের মতো। জুনিয়র জুনিয়রের মতো। একাত্মতা ছিল না। যেটা তৈরি হল এই সময়ে।

পত্রিকা: আজহার দশে ছয় হলে সৌরভ কত?
সিধু: সাড়ে আট।

পত্রিকা: ধোনি?
সিধু: ধোনি দশে নয়।

পত্রিকা: ধোনি আধ নম্বর বেশি কেন সৌরভের চেয়ে?
সিধু: আরও অ্যাচিভমেন্ট বেশি। আরও বেশি বার প্রমাণ করতে সফল। বড় টুর্নামেন্টে সাফল্যে এগিয়ে। সব চেয়ে বড় কথা অধিনায়ক হিসেবে ধোনির তুলনামূলক কম সময়ে বেশি সাফল্য!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.