সন্দীপন চক্রবর্তী • কলকাতা |
রাজ্য সরকারের একের পর এক ভুলভ্রান্তির বিরুদ্ধে পথে নামতে দেরি হচ্ছে কেন, বামফ্রন্টের অন্দরে এই প্রশ্নে সিপিএমের উপরে চাপ বাড়াচ্ছে শরিকেরা। দুবরাজপুরের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়েও তাদের এই মনোভাব জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুকে। পার্টি কংগ্রেসের দলিলে বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকই মেনে নিল, শাসক দলের বিরুদ্ধে রাজ্যের মানুষের ‘প্রতিরোধ’ গড়ে না-ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া পথ নেই।
দলের সপ্তদশ পার্টি কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবে পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তনের রাজনীতির দেড় বছর সম্পর্কে একটি পৃথক পরিচ্ছেদ রাখা হয়েছে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি এবং মহিলাদের নিরাপত্তাহীনতার কড়া সমালোচনা করে বলা হয়েছে, ‘রাজ্যের অ-রাজনৈতিক মানুষই এখন এই ‘পরিবর্তনে’র সমালোচনা করছেন এবং বলছেন যে, তাঁরা এই পরিবর্তন চাননি। পরিবর্তনের এই রাজনীতি সম্পর্কে তাঁরা সম্পূর্ণ হতাশ। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, স্বৈরতান্ত্রিক হুমকি এবং হিংসার দাপাদাপি ছাড়া তাঁরা আর কিছুই পাননি’! কিন্তু এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়া মানেই যে বামেদের সংযত থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া নয়, তা-ও কবুল করছেন ফব নেতৃত্ব।
খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে: ‘বামপন্থীদের এই পরিস্থিতিতে অতি-প্রতিক্রিয়া দেখানো এবং পাল্টা হিংসার পথে যাওয়া উচিত নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের এই হতাশা ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধে রূপান্তরিত না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত এই শাসক গোষ্ঠীর শ্রেণি চরিত্র সম্পর্কে মানুষকে বোঝাতে হবে এবং তাঁদের সচেতন করতে হবে’। বস্তুত, পার্টি কংগ্রেসের দলিলে রাজ্যের পরিস্থিতি সম্বন্ধে যে মূল্যায়ন বাম শরিক ফব করছে, সিপিএমের মনোভাবের সঙ্গে তার বিশেষ ফারাক নেই। সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “দেখতে হবে, মানুষ যেন মনে না-করেন যে বামপন্থীরা ধৈর্য হারিয়েছেন। মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে সব বুঝে নেবেন। ধাপে ধাপে আমাদের প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই পরিস্থিতিতে বামেদের ঐক্যবদ্ধ থেকেই আন্দোলনে এগোতে হবে।”
তবে বাম ঐক্য যে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ স্তরে আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে, তা নিয়ে যথেষ্ট কড়া মনোভাব দেখা যাচ্ছে ফব-র তরফে। খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘কার কত শক্তি বা প্রভাব আছে, সেগুলি নিয়ে কোলাহল না-করে যদি নীচের তলার কর্মী মহলে নিয়মিত পারস্পরিক মত বিনিময় ও কাজকর্ম করা যায়, তবেই তৃণমূল স্তরে প্রকৃত বাম ঐক্য গড়ে উঠবে’। অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন ভাবে এখানে ধরা পড়েছে বাম শরিক সিপিএমের বিরুদ্ধে দাদাগিরির অভিযোগ। কোঝিকোড়ে সিপিএমের বিগত পার্টি কংগ্রেসে গিয়ে সিপিআই নেতা এ বি বর্ধনও বাম ঐক্যকে শুধু বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ না-রেখে হাতে-কলমে তা প্রয়োগের ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন।
খসড়া দলিলে ফব-র আক্ষেপ: ‘দেখা যাবে, বাম ঐক্য প্রতৃত অর্থেই চাপা পড়ে গিয়েছে বিভিন্ন সম্মেলন ও সেখানে গৃহীত রাশি রাশি প্রস্তাবের তলায়। বিভিন্ন প্রশ্নে সময়ে সময়ে একটা করে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ এই ভাবে বাম ঐক্য গড়ে ওঠে না। বাম ঐক্য গড়ে ওঠে নিরন্তর গণ-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে’। বিভিন্ন নির্বাচনে বামপন্থীদের পরস্পরের মধ্যে লড়াইয়ের জেরে কংগ্রেস এবং বিজেপি-বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ এনে খসড়া প্রস্তাবে ফ ব নেতৃত্ব জোর দিয়েছেন ‘আত্মসমীক্ষা’র উপরে। দলিলের ভাষায়, ‘যদি এ কাজ করতে আমরা ব্যর্থ হই, তা হলে উত্তরসূরিরা আমাদের ক্ষমা করবে না’।
উত্তর-প্রজন্ম যে বাম আন্দোলনে ইদানীং বিশেষ সাড়া দিচ্ছে না, সেই সত্যও অবশ্য কবুল করা হয়েছে প্রতিবেদনে ‘শিক্ষিত যুব সমাজ আজ কেন বামপন্থী আন্দোলনে ব্যাপক ভাবে যোগ দিচ্ছে না বা তাদের মধ্যে কেন আমরা আমাদের চিন্তার সংস্কৃতিকে পরিবাহিত করতে পারলাম না, তার সুগভীর অনুসন্ধান জরুরি’।
মানুষের প্রতিরোধ আর নিজেদের অনুসন্ধানের অপেক্ষাতেই আপাতত থাকতে হচ্ছে বামেদের! |