পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এক শিক্ষা সমাবেশে বলিয়াছেন, এ রাজ্যের সরকারি বিদ্যালয়গুলি দুর্দশাগ্রস্ত। কথাটি অজানা কিছু নহে। চোখ কান খোলা রাখিলেই ইহার সত্যতা টের পাওয়া যাইবে। আর এই বিদ্যালয়গুলি তো এক দিনে ভগ্ননীড় হইয়া যায় নাই, তাহা দীর্ঘ সাধনার ফল। শব বানাইবার সাধনা। প্রথমে দীর্ঘ দিন ধরিয়া বামেরা এই কার্য করিয়াছেন। পরিবর্তিত সরকার সেই ট্র্যাডিশন ভাঙিবার জন্য যথেষ্ট উদ্যমী হইয়াছেন এমন কথা বলিবার কারণ ঘটে নাই। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীই স্বীকার করিয়াছেন, অসরকারি বিদ্যালয়ের তুলনায় সরকারি বিদ্যালয়ের পশ্চাৎপদতার কথা পুরোপুরি মিথ্যা নহে।
ইতিহাস সতত স্মরণীয়, বিশেষত আত্মবিস্মৃত বাঙালির পক্ষে। অপরাপর প্রদেশের তুলনায় বঙ্গদেশের প্রাগ্রসরতার কারণ ছিল শিক্ষা। ইংরেজি ও অঙ্ক জানা পোক্ত পড়ুয়ার দল কিন্তু একদা কোনও ব্যয়বহুল বেসরকারি বিদ্যালয় হইতে বাহির হইত না, অধিকাংশই ছিল সরকার পোষিত বিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশেষত জেলা স্কুলগুলির মান ছিল যথেষ্ট উন্নত। প্রেসিডেন্সিতে ‘সিনিয়র কেমব্রিজ’ বনাম জেলা-স্কুল হইতে আসা পড়ুয়াদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল মুখরোচক বিষয়। শিক্ষাকে হাতিয়ার করিয়া, আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিত যে ভদ্রলোক সমাজ, সেই স্বল্পবিত্ত অথচ বিদ্যাভিলাষী পরিবারের মানুষজনের কাছে সরকারি বিদ্যালয়ের কোনও বিকল্প ছিল না। সরকারি বিদ্যালয় ইংরেজ আমলে বিশেষ পরিকল্পনা ও সাধনার ফলে গড়িয়া উঠিয়াছিল। এই জেলা-স্কুলগুলির বাড়িঘর ছিল সুবিন্যস্ত, পর্যাপ্ত খেলার মাঠের অভাব ছিল না, অন্যান্য নানা পরিকাঠামোও ছিল। কাজেই বিস্তর ব্যয় না করিয়াও সাধারণ ভদ্রলোকেরা তাঁহাদের সন্তানাদিকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করিতে পারিতেন। কিন্তু দিনকাল তো সর্বদা সমান যায় না। একদা বিচিত্র এক সাম্যবাদের নেশায় নামিয়াছিল পূর্বতন বামপন্থী সরকার। ইংরাজির মহিমা খর্ব হইল, অঙ্কের ভার কমিল, ঘর-দুয়ার ও অন্যান্য পরিকাঠামো যাহা ছিল তাহা সংস্কারের অভাবে ক্রমে ক্ষয়প্রাপ্ত হইতে লাগিল। এই সহজতার সাধনায় সাম্য কতটা রক্ষা পাইল বলা মুশকিল, তবে শিক্ষাই যাঁহাদের দাঁড়াইবার উপায় সেই ভদ্রলোক পরিবারের অভিভাবকেরা ক্রমে অসরকারি বিদ্যালয়ের দিকে মুখ ঘুরাইলেন।
আর যাঁহাদের জন্য এত আয়োজন সেই প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের পড়ুয়ারাও কিন্তু সর্বদা সরকারি বিদ্যালয়ের উপর পুরোপুরি নির্ভর করিতে পারিল না। পরিবর্তিত সরকারের কাছে শিক্ষা মস্ত চ্যালেঞ্জ হিসাবে আসিতে পারিত। যাহা ভাঙিয়া পড়িয়াছে তাহা গড়িবার চ্যালেঞ্জ। এই নব্য সরকার তাহা গ্রহণ করিয়াছে বলিয়া মনে হয় না। ব্যয়বরাদ্দ করিয়া, পরিকাঠামো গড়িয়া তুলিয়া সরকারি ব্যবস্থাকে পুনরায় জাগাইবার প্রয়াস নাই— বাম আমলের তিমির এই আমলেও বজায় রহিয়াছে। শিক্ষামন্ত্রী টাকার দোহাই দিয়াছেন। বলিয়াছেন, ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধি করিয়া তো সরকার বিদ্যালয়ের কাঠামো বদলাইতে চাহে না। কিন্তু সমস্যা কেবল টাকার নহে, সদিচ্ছার ও পরিকল্পনার। |