বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সামরিক শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্র যখন জঙ্গি-অধ্যুষিত একটি ছোট অঞ্চলের অসামরিক নিরস্ত্র নিঃসহায় সাধারণ মানুষের সহিত রকেট-মর্টার-বোমার মৃত্যুলীলায় মাতিয়া উঠে, তাহাকে ঠিক ‘যুদ্ধ’ বলা চলে না। সুতরাং বুধবার মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টনের উপস্থিতিতে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের হামাসের মধ্যে যে বোঝাপড়া হইল, তাহাকেও ‘যুদ্ধবিরতি’ আখ্যা দেওয়া মুশকিল। ‘শান্তিচুক্তি’ আখ্যা দেওয়া তো আরওই অসম্ভব, কেননা এই পারস্পরিক শর্ত-বিনিময়ের ফলে যথার্থ এবং স্থায়ী শান্তির অভিমুখে অগ্রসর হইবার আশা নাই। বরং ‘অস্ত্র-সংবরণ’ শব্দটিই অধিক উপযুক্ত। এই ভয়ানক আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের অলাতচক্র হইতে সাময়িক ভাবে যুযুধান দুই পক্ষকে সংবরণ করিবার আন্তর্জাতিক প্রয়াস সফল হইল, আপাতত এইটুকুই বলা যায়। এই অস্ত্র-সংবরণের প্রয়াস সর্বার্থে সফল হইবে না। তবু দুই পক্ষেই যে নাগরিকরা পূর্ণ এক সপ্তাহ পরে একটু স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস লইতে পারিতেছেন, দিগ্ভ্রান্ত আতঙ্কময় দিন ও নিদ্রাহারা অভিশপ্ত রাতের পর ধ্বংসস্তূপে বসিয়া সামান্য স্বস্তির হাঁফ ছাড়িতে পারিতেছেন, কেবল এইটুকুর জন্যই মধ্যস্থতাকারী ওয়াশিংটন ও কায়রো-র ধন্যবাদ প্রাপ্য।
অত্যন্ত জটিল সংঘর্ষপূর্ণ পরিস্থিতিতে বিবদমান পক্ষসমূহকে জোর করিয়া সমঝোতায় রাজি করাইলে যেমন হয়, এ ক্ষেত্রেও তাহাই হইয়াছে, দুই পক্ষই উচ্চৈঃস্বরে নিজেদের ‘স্ট্র্যাটেজিক’ জয় ঘোষণা করিতেছে। তেল আভিভ-এর বক্তব্য: এ যাত্রা হামাসের উল্লেখযোগ্য সামরিক ক্ষতি সাধন করা গিয়াছে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আল-জাবরিকে হত্যা ছাড়াও হামাসের সদর দফতরটি গুঁড়াইয়া দেওয়া গিয়াছে, সত্বর আর তাহারা মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিবে না। আর একটিও রকেট গাজা-ইজরায়েল সীমান্ত পার হইবে না, এই প্রতিশ্রুতিও নাকি মিলিয়াছে। ইসলামিক জিহাদের মতো কট্টরতর, আক্রমণাত্মক গোষ্ঠীর উপর হামাস নিয়ন্ত্রণ রাখিবে, এমনও শোনা গিয়াছে। অবশ্যই, এই ধরনের শর্তের দৌড় লিখিত দলিলের বাহিরে বেশি দূর নহে। তবে লিখিত স্তরেও এইটুকু প্রতিশ্রুতি হামাস দিয়াছে, ইহা গুরুত্বপূর্ণ। গাজায় ধ্বংসকাণ্ডের পরিমাণ ইহা হইতে সহজেই অনুমেয়।
একই ধরনের জয়ভেরী বাজাইতেছে হামাসও। তাহাদের সব কয়টি লক্ষ্যই নাকি পূর্ণ: তাহাদের রকেট যে জেরুজালেম বা তেল আভিভ অবধি সহজেই পৌঁছাইতে পারে, প্রমাণিত। ইজরায়েলের ‘অপারেশন পিলার অব ডিফেন্স’ ব্যর্থ। দাবি-প্রতিদাবির তরজায় একটি বিষয় উল্লেখ্য। মিশরের সিনাই অঞ্চলের মধ্য দিয়া যে বেআইনি অস্ত্র পাচারের ফলে হামাসের এই বাড়বৃদ্ধি, তাহাতে কিন্তু শৃঙ্খল পরাইতে পারিল না ইজরায়েল। বস্তুত, আরব বিশ্বের নানা দিক হইতে প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে অস্ত্র ও অর্থ সমর্থনের প্রবাহ আটকাইবার কোনও ব্যবস্থাই ইজরায়েল এই চুক্তির মাধ্যমে কায়েম করিতে পারে নাই। কঠিন কাজ। কিন্তু এই কাজটি ছাড়া কোনও সংবরণই সার্থক হইবে না, কোনও চুক্তিই অর্থপূর্ণ হইবে না। সুতরাং এই সংবরণ বালির বাঁধ। ইতিপূর্বে শেষ অস্ত্র-সংবরণ চুক্তিটি সাধিত হইয়াছিল ২০০৯ সালে, যাহা অগ্রাহ্য ও অবজ্ঞা করিয়া অনবরত অস্ত্রক্ষেপণ দেখা গিয়াছিল দুই পক্ষেই। এ বার, আরব দুনিয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০১২-র সংবরণ চুক্তি চার বৎসরও টিঁকিবে কি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং রাষ্ট্রপুঞ্জকে মনে রাখিতে হইবে, ইজরায়েলের সহিত হামাস ও অন্যান্য প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতার পথে যদি এক পা-ও আগাইতে হয়, তবে সামরিক সংবরণ চুক্তি নহে, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। পৃথক প্যালেস্তিনীয় রাষ্ট্র নির্মাণ প্রয়োজন। ইজরায়েলের অনবরত আগ্রাসন থামানো প্রয়োজন। প্যালেস্তাইনে মাহমুদ আব্বাসের মতো মধ্যপন্থী নেতাদের কী ভাবে প্যালেস্তিনীয়দের কাছে গ্রহণযোগ্য করা যায়, সেই চিন্তা প্রয়োজন। এ সব সমাধান কিন্তু ওয়াশিংটন, লন্ডন, জেনিভার সক্রিয় অংশগ্রহণ, সুস্থ পর্যালোচনা, নিরপেক্ষ বিবেচনা ব্যতীত অসম্ভব। |