রাজনীতি, না বাস্তবতা? এই প্রশ্নের সমাধানের উপরেই নির্ভর করছে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর ভাগ্য।
রেলের নয়া প্রতিমন্ত্রী, কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী জানিয়েছেন, নকশা মেনেই হবে কাজ। প্রকল্প-পথ মধ্য কলকাতার বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে সরানো হবে না। কয়েক মাস আগে কলকাতা মেট্রো রেল নিগমের (কেএমআরসি) এমডি সুব্রত গুপ্ত মহাকরণে একটি নোট পাঠিয়ে জানান, প্রকল্প-পথ সরালে বড় জটিলতা দেখা দেবে। এর পরে ওই আইএএস অফিসারকে অন্য দায়িত্বে বদলি করা হয়। রাজ্য সরকার ওই পথ বদলের জন্য পরিবর্ত পথেরও খোঁজ করছে। এই অবস্থায় অধীরবাবুর বক্তব্য নতুন করে জটিলতার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
ইতিমধ্যেই নির্মীয়মাণ ওই প্রকল্পের কাজ প্রায় তিন বছর পিছিয়ে গিয়েছে। বাড়তি বরাদ্দের ধাক্কা পড়বে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। কেএমআরসি-র এক পদস্থ অফিসার এ কথা জানিয়ে বলেন, “মাস চারেক আগে এই প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা সমীক্ষা করে। তাতে দেখা যায়, কেবল পথ বদলের এই জটিলতার জন্যই কাজ অন্তত আড়াই বছর পিছিয়ে গিয়েছে। খরচ বেড়েছে ৫০০ কোটি টাকা। এখন যা পরিস্থিতি, মাঝের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অর্থাৎ বৌবাজারের জট না-কাটলে প্রকল্প পিছিয়ে যাবে অন্তত তিন বছর।” রাজ্য সরকারকে লেখা সুব্রত গুপ্তের নোটেও পথ বদল হলে বেশ কয়েকশো কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে বলে উল্লেখ ছিল।
রাজ্য সরকারের তরফে প্রকল্প-পথ বদলের ইচ্ছে জানানো হয় গত মার্চ মাসে। আপত্তি জানায় কেন্দ্র এবং জাপানি লগ্নি সংস্থা ‘জাইকা’। প্রকল্প রূপায়ণের ব্যাপারে কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগে তৈরি কেএমআরসি-র এমডি হিসেবে গত ৩০ জুন দায়িত্ব দেওয়া হয় সুব্রত গুপ্তকে। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে গত ২৫ এপ্রিল রাজ্য সরকারকে তিনি পাঁচ পাতার একটি নোট পাঠান। তাতে ৯টি পরিচ্ছেদে বিস্তারিত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে তিনি পথ বদল না করার পরামর্শ দেন। লেখেন, “প্রকল্পের কাজ এমনিতেই পিছিয়ে গিয়েছে। যদি পথ বদলের জন্য আরও পিছিয়ে যায়, তা যাত্রীদের, বিশেষত কলকাতা ও হাওড়ার লোকের কাছে চরম হতাশার কারণ হয়ে উঠবে।” এর পরে তাঁকে ওই পদ থেকে সরে যেতে হয়। গত প্রায় ন’মাস প্রকল্পের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কাজে ভাটা পড়েছে। জটিলতার জন্য রাজ্য সরকার এবং কেএমআরসি দায়ী করেছে বৌবাজারের ব্যবসায়ীদের। কিন্তু ‘সেন্ট্রাল ক্যালকাটা সিটিজেন্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর যুগ্ম সম্পাদক সমর দত্তের দাবি, “আমরা চেয়েছিলাম, উপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে উন্নয়নের কাজ হোক। এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা, তৎপরতা ও দৃষ্টিভঙ্গির অভাবের জন্য সমস্যা দেখা দিয়েছে।”
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কেএমআরসি-র আধিকারিকেরা জানান, “এই কাজের জন্য বৌবাজারে ১.০৭ একর জায়গা দরকার। সরাতে হবে ১৫৭ জনকে। গত ৯ মার্চ থেকে বিভিন্ন দফায় বৈঠকের পরে কাছেই তিনটি জায়গা চিহ্নিত হয়। তাঁদের অর্ধেকের পুনর্বাসনের পাকা ব্যবস্থা হলেও সকলের ব্যবস্থা একসঙ্গে না করায় ওঁরা সরতে চাননি।” অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া ৮০ শতাংশ হয়ে গিয়েছে। ১০ কোটি টাকায় পুনর্বাসনের জন্য তৈরি বাড়ি পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। কেএমআরসি-র এক পদস্থ অফিসার এ কথা জানিয়ে বলেন, “এ সব সত্ত্বেও রাজ্যের সাম্প্রতিক অনীহার জন্য পুনর্বাসনের কাজ শেষ করা যায়নি।”
সুব্রতবাবুকে সরিয়ে রাজ্য কেএমআরসি-র এমডি পদে আনে পরিবহণসচিব বি পি গোপালিকাকে। সমস্যাটা কোথায়? তিনি বলেন, “এখন আমরা এই প্রকল্পের দায়িত্বে নেই। তাই প্রকাশ্য মন্তব্য করব না।” তবে রাজ্যের বক্তব্য, “বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট দিয়ে এই মেট্রো নিয়ে গেলে অনেক জটিলতা দেখা দেবে। সময় এবং অর্থ দু’টোই বেশি লাগবে।” অন্য দিকে রেল মন্ত্রকের বক্তব্য, “বহু ভাবনাচিন্তা করে, বিভিন্ন স্তরে আলোচনার পরে প্রকল্পের নকশা তৈরি হয়েছিল। এই নকশা বদল করলে কেন্দ্র এবং ‘জাইকা’-র অনুমোদন দরকার। এই পথ বদলে ওদের অনুমতি নেই। এই বদল করার প্রথাটাও অত্যন্ত জটিল। তাই পূর্ব-নির্ধারিত পথেই হবে প্রকল্প।”
এই অবস্থায় কেএমআরসি বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে কাজ শুরু করলে পুরসভা কতটা সহযোগিতা করবে? মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের কাছে ওরা কোনও অনুমতি চেয়েছে বলে শুনিনি। আবেদন করুক, তার পরে নিশ্চয়ই দেখব।” কিন্তু এই চাপান-উতোরের মাঝে হাওড়া এবং বেলেঘাটা দু’দিক থেকে শহরের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত যে ঠিকাদারেরা কাজ পেয়েছেন, তাঁরা ধন্দে পড়েছেন। |