ব্রিটিশ প্রেস ধরেই নিয়েছে শুক্রবার থেকে ওয়াংখেড়েতে যে দ্বিতীয় টেস্ট শুরু হচ্ছে তা আমচি মুম্বইয়ে সচিন তেন্ডুলকরের শেষ টেস্ট ম্যাচ পদার্পণ। ধরে নিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্রও ভেবে নিয়েছে। তেন্ডুলকর ঘনিষ্ঠদের ইন্টারভিউ নেওয়া। মুম্বই শহরে সচিনের স্মৃতির সঙ্গে একাত্ম এমন বিশেষ বিশেষ জায়গায় ছবি তোলানো। বিশাল জোগাড়যন্ত্র করছে তাদের সংবাদমাধ্যম। এমনকী বিলেতের অভিজাত ব্রডশিটও বাকি নেই।
অথচ খোদ মুম্বইয়েই অন্য বারের মতো বাতাসে সচিন-মন্ত্রের খোঁজ নেই। মুম্বই এখনও প্রাক্তন শিবসেনা সর্বাধিনায়কের মৃত্যু সম্পর্কিত হ্যাংওভারের চূড়ান্ত ধাপ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বিমানবন্দর থেকে বার হতে না হতেই সেই যে বালাসাহেবের ছবি দেখলেন, ওটাই টানা চলতে চলতে শহরের আর এক প্রান্তে নরিম্যান পয়েন্ট পর্যন্ত আপনাকে নিয়ে গেল। দুই তরুণীর ফেসবুকে নির্দোষ মন্তব্যকে কেন্দ্র করে শিবসৈনিকদের গুন্ডামি। তাদের প্রশাসনের চাপে পড়ে গ্রেফতার করা নিয়ে জনমানস এত তিতকুটে যে, তেন্ডুলকর এবং গোরাদের বিরুদ্ধে তাঁর আসন্ন লড়াই নিয়ে কোনও সাড়াশব্দ শুনলাম না।
স্থানীয় ক্রিকেট মিডিয়াও যেন খানিকটা চিত্রার্পিতের মতো শিবাজি পার্কের শবদেহ ঘিরে লাখ লাখ মানুষের ভিড়টিড়ের মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ রেখেছে। বেশ ইন্টারেস্টিংই যে, ইংরেজ সাংবাদিকেরা যখন মরাঠি মানসের মধ্যে ঢুকে তেন্ডুলকরের ঘরের মাঠে বিদায়কে ক্লোজ-আপে আনতে চাইছে, তখন স্থানীয় প্রেসের মাথাতেই নেই ব্যাপারটা। |
দুই মেজাজে কপিল দেব |
যোগরাজের (কালো জহর কোটে)
থেকে দূরে এবং গম্ভীর। |
বেঙ্গসরকরের সঙ্গে কিন্তু দিব্যি হাসিখুশি।
মুম্বইয়ে। ছবি: উৎপল সরকার |
|
ব্রিটিশ মিডিয়ার অঙ্কটা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার নয়। সব কিছু ঠিকঠাক চললে মুম্বইকরদের সামনে সত্যিই জীবনের শেষ টেস্ট খেলতে নামছেন সচিন! এর পর অস্ট্রেলিয়া সিরিজের একটাও টেস্ট মুম্বইয়ে নেই। শেষ হয়ে গেল মরসুম। আর ২০১৩-১৪ মরসুমে তো ঘরোয়া কোনও টেস্ট সিরিজেরই ব্যবস্থা নেই। ভারত খেলবে দক্ষিণ আফ্রিকা আর নিউজিল্যান্ডে। পড়ে থাকল ২০১৪-র শীত। তখন তেন্ডুলকরের বয়স হবে একচল্লিশ প্লাস। ওই বয়সে তিনি ভারতের হয়ে টেস্ট খেললে অ্যালিস্টার কুককেও বাংলা অ্যাকাডেমিতে সাহিত্যচর্চার সম্মেলনে পাওয়া যাবে!
তবে বিদায়ের গন্ধ যতই উঁকিঝুঁকি মারুক, ব্র্যান্ড তেন্ডুলকরের বাজার এখনও ইংল্যান্ডের হুমড়ি খেয়ে স্পিন খেলার মতো অবস্থায় পৌঁছয়নি। বরঞ্চ আরও একটা বিশ্ববিখ্যাত সুইস ঘড়ি তাঁকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে সই করাল। বুধবার তাজমহল হোটেলে তার সরকারি অনুষ্ঠান। বৃহস্পতিবার আবার সচিনের উপর নতুন ক্রিকেট-বই প্রকাশ। যার উদ্বোধন করতে রাজি হয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়। সচিন নিয়ে এই সব চর্চা আগামী দু’দিন কাগজে-টাগজে, টিভির চ্যানেলে-ট্যানেলে হলে হয়তো টেস্টের বাজার কিছুটা চাঙ্গা হবে।
এ দিন শেষ দুপুরে ছিল আরও একটা বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠান। বিষয় অবশ্য সচিন নন। তাঁর পরম প্রিয়পাত্র যুবরাজ সিংহ। লেখক বহু দিনের অভিজ্ঞ ক্রিকেটলিখিয়ে মকরন্দ ওয়েঙ্গাকর। ব্যতিক্রমী প্রকাশ অনুষ্ঠান কারণ, বহু বছর বাদে এই অনুষ্ঠান প্রকাশ্যে আনল যুবরাজের বাবা যোগরাজ সিংহ এবং এক সময় তাঁর নতুন বলের দোসর কপিল দেব নিখাঞ্জকে। এককালে হরিয়ানার পক্ষে এঁরা ত্রাস সৃষ্টিকারী কম্বিনেশন ছিলেন। কিন্তু যত সময় যায় ততই যোগরাজকে ছাড়িয়ে উত্থান ঘটতে থাকে কপিলের। ’৮১-র মেলবোর্ন টেস্ট যখন যন্ত্রণাকাতর পা নিয়ে ভারতকে জেতাচ্ছেন কপিল, তখন যোগরাজ প্রথম এগারো থেকে ছিটকে গিয়েছেন এক টেস্টে ৬৩ বোলিং গড় নিয়ে। ওয়ান ডে খেলেছিলেন সে বার ছ’টা। বোলিংয়ে ৪৬ গড় নিয়ে শেষ করেন। তিনি যোগরাজ অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মতো পেসার সহায়ক পিচে যদি উইকেট না পান, কপিল কী করতে পারেন?
কিন্তু তাই হয়েছে। ঐতিহাসিক ভাবে নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য কপিলকে দায়ী করে এসেছেন যোগরাজ। এ দিন যেমন বলতে উঠে উদ্বোধক কপিল এবং প্রধান অতিথি বেঙ্গসরকরকে রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দিলেন। বললেন, “লন্ডন থেকে ফোন করে আমায় যুবি বলল, বাবা আমি খুব অসুস্থ। আমার ক্যানসার হয়েছে। আমি তখন ওকে উত্তেজিত ভাবে বলি, তোমার কিছু হতে পারে না। তুমি হলে আমার হৃদয়ের জখমের জবাব। তোমার কিছু হতে পারে না। ঈশ্বর তোমায় বাঁচিয়ে রাখবেন আমার হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।” যোগরাজ এক বারও কপিলের দিকে না তাকিয়ে বললেন, “স্টেজের ওপর সব মহান ক্রিকেটার বসে রয়েছেন। আমি ওদের মতো জীবনে হতে পারিনি। কিন্তু মকরন্দ যেমন বই লিখছে আমিও আত্মজীবনী লিখব। লিখে সব গোপন কথা, সব কুকীর্তির ইতিহাস ফাঁস করব।” কপিল কিছু পরে বলতে উঠলেন। যোগরাজের নামও উচ্চারণ না করে যুবরাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। |
এক সময় বেঙ্গসরকরকে ‘ছোটে নবাব’ বলতেন কপিল।
এখন দু’জনে বন্ধু। মঙ্গলবার মুম্বইয়ে। ছবি: ইন্দ্রনীল রায় |
না কপিল, না বেঙ্গসরকর কারও বক্তৃতাতেই কিন্তু ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্রসঙ্গ উঠল না। উঠল না আশিস কৌশিক নামক সেই ফিজিওর কথা, যাঁর কথা ভারতীয় ক্রিকেট-অলিন্দে এখন সবচেয়ে বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে। বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই তরুণ ফিজিও নাকি অন্তরালে পেশাদারিত্ব বদলে দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের। শুধু যুবরাজকেই সুস্থ করে দেননি। চেতেশ্বর পূজারাকেও পুরো বদলে দিয়েছেন। দু’বার হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের পর চেতেশ্বর যখন এনসিএ-তে আসেন তাঁর দু’বগলে ক্রাচ। সেই অবস্থা থেকে তিনি যে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করবেন, তার পর ক্লোজ ইনে রোদ্দুরে এতক্ষণ ফিল্ডিংকেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। যুবরাজও তো আড়াই দিন ফিল্ড করার পর বুধবার টিমের সঙ্গে আবার নেটে যাবেন। তাঁর ম্যানেজার জানালেন, যুবি সম্পূর্ণ সুস্থ। ধোনি অবধি বললেন, “হ্যাঁ, যুবরাজকে ফিটই দেখাচ্ছে।”
ধোনি বলতে গিয়ে মনে পড়ল, কপিল তাঁর আম্পায়ারদের বিরুদ্ধে সমালোচনার যথেষ্ট কারণ খুঁজে পাননি। বললেন, “এতগুলো আউট যে না দেওয়ার কথা বলছে, সেগুলো কোন আউট? আমরা যে খেলাটা মন দিয়ে দেখেছি তার মধ্যে তো ছিল না!”
মুম্বই ক্রিকেটমহলে অবশ্য ধোনির ফেটে পড়া নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খোঁজ নেই। অন্তত মঙ্গল-বুধবার পর্যন্ত তাদের ক্রিকেটে ঢোকার সুযোগ নেই। তার পর ঢুকবে সচিন নামক স্টেশনে! |