প্রবন্ধ ২...
সুনীল আছো, সুনীল
রজায় ধাক্কা দিয়ে এ ভাবে ডাকার মতো ঘনিষ্ঠতা কখনওই তাঁর সঙ্গে আমার হয়নি। কোনও দিন না। পরিচয় চার দশকের বেশি। তাঁকে প্রথম পড়েছি তাঁর প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ-এ, পঞ্চাশ বছর আগে। পরিচয়ের পর থেকেই সুসম্পর্ক কখনও নষ্ট হয়নি, ময়লা লাগেনি। তাঁর কিছু চিঠিপত্র আজও রয়েছে আমার কাছে, বেশির ভাগই পোস্টকার্ড, কাজের কথাই বেশি সেগুলিতে। পাঠ: প্রীতিভাজনেষু বা সুহৃদ্বরেষু। এক সঙ্গে কাজও করেছি কিছু: দুই বাংলার ভালবাসার গল্প-র সম্পাদনা। এক মঞ্চে কথা বলেছি দু’জনে রাঁচিতে এক বার একটু-আধটু ঠেস দিয়ে পরস্পরকে। আমাদের ভাবনা যে দু-দিকে যায়, মেলাতে পারি না যে! আমার ধারণা, প্রীতি-সৌহার্দ আর নির্ভেজাল সম্পর্কের বন্ধন কট্টর মতদ্বৈধের মধ্যেও সহাবস্থান করতে পারে। বস্তুত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কে সেটাই ঘটেছে দেখতে পাই।
ষাটের দশকের এক রকম শুরু থেকেই আমার সুনীল পড়া শুরু। কিন্তু পুরো দশক জুড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। এই দশ বছরে সুনীল এত বেশি পড়া হয়েছে, মানুষটা এত বেশি আমার কাছে সড়গড় হয়ে এসেছে যে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে যখন তাঁকে প্রথম দেখলাম, আলাপ হল, মনে হল না খুব নতুন এক জন লেখকের সঙ্গে পরিচয় হল। বরং ষাটের দশকের সুনীলই আমার কাছে বেশি পরিচিত, বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে রইলেন। কলকাতায় প্রথম সাক্ষাৎ খুব স্বল্প সময়ের জন্যে, আলাপও নেহাত সৌজন্যমূলক ছিল। প্রথম পরিচয়ের জড়তা আড়ষ্টতা থেকেই গেল যেন। কিন্তু তখনই জানি সুনীল আমার কাছের মানুষ, প্রিয় লেখক, তাঁর সান্নিধ্যের ঘনিষ্ঠতার মধ্যেই রয়েছি। অবশ্য প্রথম আলাপ নেহাত আনুষ্ঠানিক ছিল বলেই বোধহয় এ রকম ঘটে গেল। নিজের পার্টিশন দেওয়া ছোট্ট ঘরটিতে বসে তিনি লিখছিলেন। সাধারণ নিউজপ্রিন্ট কাগজে বল পেনে এক মনে লিখতে লিখতেই তিনি আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। আমার সঙ্গে ছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, মতি নন্দী, আর বোধহয় শ্যামলদা। পরিচয় করিয়ে দিতে মৃদু হেসে মৃদু কণ্ঠে বললেন, আপনার লেখা আমি পড়েছি, পড়ি।
‘কাছের মানুষ, প্রিয় লেখক।’
কাজের জায়গায় বসবার ব্যবস্থা নেই, সুনীলের সময়ও নেই। তাঁর ব্যবহারে উচ্ছ্বাস নেই, আতিশয্য নেই, তবে টের পাচ্ছি তাঁর শান্ত আন্তরিকতা আর সৌহার্দের আশ্বাস। আমরা কলেজ স্ট্রিটের দিকে যাচ্ছি শুনে সন্দীপন বা মতি নন্দীকে বললেন, যাচ্ছো যখন, অমুক দোকান থেকে আমার একটা বই হাসানকে দিয়ে দিয়ো।
প্রথম আলাপ এইটুকুই। বলতে কী এর পরেও সব সময়ই এটুকুই। দীর্ঘ দীর্ঘ সময় তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে কাটেনি। উপলক্ষ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতা তো যাওয়া ঘটত না। সুনীল ঢাকায় এলেও তেমন দেখা হত না। আমি ১৯৭৩ থেকেই রাজশাহিতে। হয়তো দৈবক্রমে দু’জনেই ঢাকায় রয়েছি, তবু দেখা হল না। মনে হয় বন্ধুবৃত্ত আলাদা ছিল। বেলাল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, হুমায়ুনও দূরের কেউ ছিলেন না। ওঁদের এক সঙ্গে ঢাকায় আড্ডা বেশ বিখ্যাতই হয়ে উঠেছিল। আমি কখনও শরিক হয়েছি বলে মনে পড়ে না। সুনীলের সঙ্গে দেখা হত বরং নানা সাহিত্য সংস্কৃতির মঞ্চে। শেষ দেখেছি স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘কেন্দ্রীয় খেলাঘর উৎসব’-এ। সেখানেও যা হওয়ার তাই হল। আমার কথাগুলো একটু ভারী, মানুষের ঘাড়ে কিছু দায় চাপায়, সুনীলের কথা রসে ভরা, হালকা আরামদায়ক বসন্তের বাতাসের মতো। ষাটের দশকের গোড়ায় খুব হাত-পা ছুড়ছি, সাহিত্যিক হতে হবে। মদির উৎসাহে উৎফুল্ল মৌমাছির মতো ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। দেশি-বিদেশি যা পাচ্ছি তাই গোগ্রাসে গিলছি। আমরা সব নতুন জোয়ান হনুমান! সর্দার বুড়ো হনুমানদের তাড়িয়ে দিতে হবে সাহিত্যের হারেম থেকে। কলকাতায় ‘স্যাড জেনারেশন’ মানে ‘বিষণ্ণ প্রজন্ম’ তড়পাচ্ছি। এখানে ‘হাংরি জেনারেশন’। ‘স্যাড জেনারেশন’ গোটা হাওড়া ব্রিজ গিলে খাচ্ছে, এখানে ক্ষুধার্তরা খাবার খোঁজার চাইতে হাংরি থাকতেই বেশি পছন্দ করছে। ‘টাইম’ পত্রিকায় দেখছি জঙ্গুলে দাড়িওয়ালা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে পুলিশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সুনীলও বোধহয় পাশে পাশে যাচ্ছে। একটা উন্মাদনা হয়তো আমাকেও পেয়ে বসেছিল। তবে থাকতাম ঢাকা থেকে অনেক দূরে। একেবারে ভেসে যেতে পারি না— জর্জরিত উলঙ্গ নিগৃহীত বাংলাদেশ চোখের সামনে— আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশক শুরু হয়ে গেছে। কাজেই ঢাকা থেকে শুধু ভাবলেশহীন প্রত্যাখ্যান, শুধুই ভাঙা খোল, ভিতরে শাঁস নেই কিছু। তখন বুঝতে পারিনি, শুধুই চেয়েছি নতুন কিছু হোক। সময় আমাদের একেবারেই চেপে ধরেছে। মুক্তি চাই, সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষা-রাজনীতি যত রকমের প্রতিষ্ঠান আছে গুঁড়িয়ে ফেলা দরকার। সেটা কেমন করে হবে, কী কী করার জন্য তা নিয়ে ভাবছিল না, অবশ্য সেটা এখন ভাল করে বুঝতে পারছি। পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতি ভিন্ন থাকলেও পচন আর জরার আক্রমণ সেখানেও প্রবল। এখন দেখতে পাচ্ছি সময়কে নতুন ভাবে পেতে চাইলে নতুন নতুন জেনারেশনের কথা উঠবেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এমনই এক জেনারেশন ‘লস্ট জেনারেশন’। বদলে যাওয়া পৃথিবীর জন্যে তার দরকার হয়। এত কথা তুলছি এই জন্য যে সুনীলকে, বিশেষ করে প্রথম পর্যায়ের সুনীলকে বোঝার পরিপ্রেক্ষিতটার দিকে তাকানো চাই। সেই সময়ে সমরেশ বসুর বিবর বেরিয়েছে। বিমল করের উপন্যাস, নতুন রীতির গল্প। তবে আমি আত্মপ্রকাশ উপন্যাস থেকেই নতুন সময়ে মানুষদের, নতুন সময়ের তরুণ-তরুণীদের দেখতে পেয়েছিলাম। টাঁকশাল থেকে নতুন টাকা ঠিকই বেরিয়ে আসে বটে, নতুন থাকে কত দিন? আত্মপ্রকাশ, প্রতিদ্বন্দ্বী, অরণ্যের দিনরাত্রি সুনীলের নতুন টাকা। শেষ জীবনের লেখা পর্যন্ত এই নতুন আনকোরা দৃষ্টির একটা ছাপ থাকলেও, সুনীল বদলাতে থাকেন অবশ্যই। বিস্তৃত জীবনপট আঁকতে শুরু করছেন, প্রচুর পড়াশোনা করছেন, দেশ-বিদেশের সাহিত্য খুঁজছেন, নিজের চিন্তা থেকে যা বেরোয় তা নিচ্ছেন, দেশ সমাজ রাষ্ট্র ইতিহাস তাঁর লেখায় ঢুকে পড়ছে। তিনি নিজেই তাঁর আত্মদুর্গ ভেঙে ফেলছেন আর অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন।
সুনীলের প্রতি ভালবাসার এই লেখাটি এ বার আমি শেষ করব। খাঁটি সাহিত্য আর জনপ্রিয়তার বিরোধ তিনি অনেকটাই মিটিয়েছেন। রুখেও দাঁড়িয়েছেন, প্রতিবাদও করেছেন, মানুষদের পক্ষে যা স্বাভাবিক। তিনি অমরলোকে পৌঁছেছেন কি না জানি না। অমরলোকের ভূগোল সমাজ আমার জানা নেই। আমার ধারণা, অমরলোক এই পৃথিবীতেই থাকে। এখানে যাঁরা নিজের পায়ের ছাপ রাখেন, তীব্র রেখাচিহ্ন রেখে যান, তাঁরাই অমর। সুনীল এখন থেকে অমর বলেই আমাদেরও কাছে গ্রাহ্য।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.