কবি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। আজ অমিত মিত্র যাহা ভাবিতেছেন, এক কবি বহু পূর্বে তাহা লিখিয়া রাখিয়াছেন ‘স্বপন যদি মধুর এমন (হোক সে মিছে কল্পনা), জাগিও না আমায় জাগিও না’। অমিত মিত্র জানেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁহারা এমনই বাস্তব রচনা করিয়াছেন যে স্বপ্নের কল্পরাজ্যই একমাত্র আশ্রয়। সেই কল্পনার পশ্চিমবঙ্গ ধনধান্যপুষ্প ভরা, শিল্পপতিরা সেখানে নিয়মিত বিনিয়োগের প্রস্তাব করিতেছেন, নিজেদের উদ্যোগে জমি কিনিয়া লইতে তাঁহাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই। এই স্বপ্নটি অমিত মিত্রের একার নহে, ইহা সম্মিলিত খোয়াব। তিনি সম্প্রতি এক বণিকসভায় সেই খোয়াবনামার একটি পৃষ্ঠা পড়িয়া শুনাইলেন। সেই পৃষ্ঠায় মালদহ আর কোচবিহারের বিমানবন্দরের স্বপ্ন ছিল। মন্ত্রিবর জানাইয়াছেন, এই দুইটি বিমানবন্দর এখন কার্যোপযোগী। বস্তুত, কোচবিহারে একটি বিমানসংস্থা উড়ান চালু করিতে চলিয়াছে। বাস্তব অবশ্য ভিন্ন। দুইটি বিমানবন্দরের রানওয়েই মাটির। তাহাতে ঘাস গজাইয়াছে, ফলে গরুও চরিতেছে। বিমান ওঠানামা করিবার মতো অবস্থায় আসিতে অন্তত দুই বৎসর সময় লাগিবে। এই বিমানবন্দরে, অতএব, কোনও সংস্থাই উড়ান চালু করিতেছে না।
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী কি জ্ঞানত মিথ্যা কথা বলিলেন? দুর্জনে এমন সংশয় প্রকাশ করিবে বটে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী সন্দেহের অতীত। বাস্তব যখন অসহনীয় হইয়া উঠে, কল্পনার ক্রোড়ে আশ্রয় লওয়া নূতন কোনও ঘটনা নহে। মনস্তত্ত্ববিদরা এই প্রবণতার ব্যাখ্যা দিবেন। কিন্তু সেই আলোচনা আপাতত থাক। রাজ্যের বর্তমান শাসকরা কেমন পশ্চিমবঙ্গ চাহিয়াছিলেন? অনুমান করা চলে, তাঁহারা একটি শিল্পোজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছল রাজ্য গড়িতে চাহিয়াছিলেন, যেখানে উত্তরবঙ্গের দুই শহরেও বিমানবন্দরে নিয়মিত বিমান ওঠানামা করিবে। অথচ তাঁহারা নির্মাণ করিলেন এমন একটি রাজ্য, যেখানে কলিকাতা বিমানবন্দরও মৃতপ্রায়। প্রায় সব আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থা এই শহর হইতে ব্যবসা গুটাইয়া লইয়াছে। যে কয়টি বিমান এখনও কলিকাতার রানওয়ে হইতে উড়ে, তাহাতে বিনিয়োগকারীদের ভিড়। তাঁহারা রাজ্যান্তরে পাড়ি দিতেছেন। পশ্চিমবঙ্গের নাম শুনিলে শিল্পপতিরা শিহরাইয়া উঠিতেছেন। এই বাস্তব মানিতে কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। যে রাজ্য কল্পনায় ছিল, আর যে রাজ্যের বাস্তবে কালীঘাট হইতে মহাকরণ দাঁড়াইয়া আছে, উভয়ের মধ্যে আলোকবর্ষের দূরত্ব। এই অবস্থায় মনকে প্রবোধ দেওয়া দূষণীয় কি? মুখ্যমন্ত্রী দেন। রাজ্যের যেখানে যাহাই ঘটুক না কেন, তিনি জানাইয়া দেন সব ঠিক আছে, কিছু দুর্বৃত্ত ষড়যন্ত্র করিয়া সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করিতেছে মাত্র। ইহা নিজের মনকে ভুল বুঝানো বই আর কী? অর্থমন্ত্রী আর এক ধাপ আগাইয়াছেন। তিনি তাঁহার কল্পনাকেই বাস্তব জ্ঞান করিতেছেন। স্বপ্নভঙ্গের হতাশা এই রাজ্যের মানুষ বুঝেন হাজার হউক, পরিবর্তনের স্বপ্ন লইয়াই তো তাঁহারা ভোট দিয়াছিলেন। অতএব, ভয় নাই।
স্বপ্নভঙ্গ কেন হইল, সেই প্রসঙ্গটি অধুনা বহুচর্চিত। তবু রাজ্যের হতাশ নেতাদের একটি কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন। স্বপ্ন দেখিলেই হয় না, সেই স্বপ্নের প্রতি বিশ্বস্ত হওয়া প্রয়োজন। অর্থনীতি নির্মম। তাহার মা-মাটি-মানুষের স্লোগান নাই, বাজার আছে। সেই বাজারের নিকট গ্রহণযোগ্য হইয়া উঠিতে পারিলে তবেই ঝলমলে অর্থনীতির স্বপ্ন দেখিবার অধিকার জন্মে। মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁহার সহকর্মীরা যদি সত্যই চাহিয়া থাকেন যে শুধু কলিকাতা নহে, কোচবিহারেও নিয়মিত বিমান উড়িবে, তবে সেই চাওয়াকে সম্মান করিবার দায়িত্বটিও তাঁহাদেরই উপর বর্তায়। শিল্পকে কুলার বাতাস দিয়া বিদায় করিবার পর হতাশ হইয়া স্বপ্নের দুনিয়ায় হারাইয়া যাওয়া অর্থহীন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আচারে-বিচারে জ্যোতি বসুর বিপরীত মেরুর মানুষ। অথচ শিল্পের প্রতি উদাসীনতায় দুই জনের মিল অতি বিস্ময়কর। শ্রীবসু ভাবিয়াছিলেন, বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজন থাকিলে তাঁহারাই রাজ্যে আসিবেন; শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ও ঠিক তেমনই ভাবেন। ভাবেন যে, সরকার জমি না দিলেও, ন্যূনতম সহযোগিতা না করিলেও শিল্প এমনিই আসিবে। তাহা হয় না। তাহা হয় নাই। এখন স্বপ্নে মুখ লুকাইয়া থাকা ভিন্ন উপায় কী? |