|
|
|
|
বালাসাহেব প্রয়াত, খোলা মাঠে অন্ত্যেষ্টি |
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • মুম্বই |
ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটে পেরিয়েছে সদ্য। মাতোশ্রীর দরজা প্রায় ভেঙে ফেলে প্রচণ্ড গতিতে ভিতরে ঢুকে গেল রাজ ঠাকরের গাড়ি। তখনই স্পষ্ট হল, আশঙ্কা বোধ হয় সত্যি হয়েছে।
প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শিবসেনা প্রধান। অগ্ন্যাশয়ও অকেজো হয়ে পড়েছিল। বাড়ি ফিরেছিলেন তিন দিন আগে। ফের অসুস্থ হয়ে পড়ায় মাতোশ্রীতেই ছিলেন লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে। তিন দিন কোনও মেডিক্যাল বুলেটিন হয়নি। কিচ্ছুটি না বলে গোমড়া মুখে মাতোশ্রী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন লীলাবতী হাসপাতালের চিকিৎসকরা। আজ মাতোশ্রীর বাইরে এসে দাঁড়ালেন জলিল পার্কার। ৮৬ বছরের বালাসাহেবকে যে চিকিৎসক দল শুশ্রূষা করছিলেন, তার প্রধান। জানালেন, “বিকেল ৩টে ৩০ মিনিটে প্রয়াত হয়েছেন বালাসাহেব ঠাকরে। তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমাদের সব চেষ্টা বিফলে গিয়েছে।”
বুধবার রাত থেকেই আশঙ্কা বাড়ছিল, আর বোধ হয় ফেরানো গেল না প্রবীণ এই নেতাকে। যদিও দলের মুখপত্রে বলা হচ্ছিল, সুস্থ হয়ে উঠছেন ঠাকরে। হাজার হাজার মানুষ ঘিরে ফেলেছিলেন মাতোশ্রী। শুরু হয়েছিল প্রার্থনা, নমাজ, যজ্ঞ।
দাবানলের মতো মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাতোশ্রীর সামনে ভিড় বাড়তে শুরু করে। কাল সকালের আগে এ ভিড় সরছে না। মাতোশ্রীতেও ঢুকে পড়তে চেয়েছিল জনতা। পুলিশের ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা বলয় কোনও ক্রমে তা সামলায়। কাল সকালে যখন বালাসাহেবের দেহ মাতোশ্রীর বাইরে বেরোবে, জনতা তখনই প্রথম দর্শন চায় নেতার। তিনি যে এ ভাবে দর্শন দেবেন কে জানত? ব্যালকনিতে এসে একটি বার হাত নাড়ুন, কাল পর্যন্ত এই ছিল আকুল আর্তি। আর আজ? ভেঙে পড়েছে জনতা। হাউ হাউ করে কাঁদছে।
শিবাজি পার্কের উল্টো দিকেই শ্মশান। কিন্তু সেখানে নয়, পার্কের মধ্যেই লাখো জনতার সামনে ঠাকরের শেষকৃত্য করতে চান শিবসেনা নেতৃত্ব। এর আগে লোকমান্য তিলকের এমন খোলা মাঠে অন্ত্যষ্টি দেখেছে মুম্বই। তার পরে বালাসাহেব। মঞ্চ তৈরির কাজ আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। কাল সকাল সাতটায় মাতোশ্রী থেকে বেরিয়ে মরদেহ আসবে এখানেই। রাখা হবে সাধারণের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য। ৪৬ বছর আগে শিবসেনা গঠনের পর এই পার্কেই প্রথম বড় জনসভা করেন বাল ঠাকরে। প্রতি বছর দশেরার দিনে এই পার্কের মঞ্চ থেকেই অনুগামী জনতাকে সম্ভাষণ করেছেন তিনি। তাই এখানেই শেষকৃত্য চায় দল।
কিন্তু শিবসৈনিকরা ভালই জানেন, মাতোশ্রী থেকে দাদারের শিবাজি পার্ক, এই শেষ যাত্রা মোটেই আর পাঁচটি ঘটনার মতো নয়। ‘সেনা ভবন’ ঘুরে মাত্র চার কিলোমিটার যেতে তিন-চার ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে তাঁদের। পুলিশের পক্ষ থেকেও সতর্ক করা হয়েছে, প্রয়োজন না হলে কাল বাড়ি থেকে কেউ যেন না বার হন।
আজ মৃত্যুর খবর আসার পর থেকেই মুম্বইয়ের বহু জায়গায় দোকানপাট বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কোথাও স্বেচ্ছায়, কোথাও আতঙ্কে। কড়া পাহারায় মহানগরীকে মুড়ে ফেলা হয়েছে। মোতায়েন হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার পুলিশ। মোড়ে মোড়ে গড়া হয়েছে চৌকি। নিরাপত্তার কারণে কাল বন্ধ থাকবে মুম্বইয়ের সব সিনেমাহল। নয় নয় করে গোটা ৬৫। আজ বালাসাহেবের মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই সেগুলির সব শো বাতিল করা হয়েছিল। রাস্তা থেকে উধাও লাখ খানেক ট্যাক্সি আর অটো।
তিনি ক্ষমতায় থাকুন বা না থাকুন, জীবিত অবস্থায় বালাসাহেবের হাতেই ছিল মুম্বইয়ের নিয়ন্ত্রণ। পাকিস্তানিরা খেলবেন কি না, তা তো স্থির করতেনই, বিগ-বি-কে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি মানাবে কি না, সেটিও বলে দিতেন অনায়াসে। এই যাঁর প্রভাব, তাঁর শেষ যাত্রায় কাল ভিভিআইপি-দের ভিড় তো হবেই। সুষমা স্বরাজের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী আজ সংসদ অধিবেশনের আগে বিজেপির সঙ্গে নৈশভোজ বাতিল করে দেন। রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন জানিয়েছিলেন ঠাকরে। তিনিও মুম্বই আসতে চান। মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধী থেকে লালকৃষ্ণ আডবাণী, শরদ পওয়ার, লালু প্রসাদ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শোক প্রকাশ করেছেন সকলেই।
আর মাতোশ্রীর ভিতরে?
ভেঙে পড়েছে ঠাকরে পরিবার। দুই ছেলে জয়দেব আর উদ্ধবও। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে শিবসেনার কাযর্নির্বাহী সভাপতি উদ্ধবের শরীরও ভাল নেই। রেকর্ড করা বিবৃতিতে তিনি শুধু বললেন, “শিবসৈনিকরা শান্ত হোন। কোনও অপ্রিয় ঘটনা যেন না ঘটে, সে কথা প্রচার করুন।” এই অবস্থায় শোকবার্তা দিতে আসা মানুষজনকে সামলাচ্ছেন ভাইপো রাজ ঠাকরেই। দলের উত্তরাধিকার নিয়ে মতভেদে মাতোশ্রী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন রাজ। নতুন দল গড়েছেন। বহু শিবসৈনিকই ভেবেছিলেন, বালাসাহেবের মৃত্যুই তাঁর অভিমান ঘোচাবে। হয়তো ভবিষ্যতের নতুন তারকা রাজই। মাতোশ্রীতে তাঁর ঝোড়ো প্রবেশ কি তারই ইঙ্গিত? |
|
|
|
|
|