ব্যাগ গুছিয়ে... |
চাঁদনি রাতে মাইথন
বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা দিগন্ত বিস্তৃত দামোদরের জলে কে যেন
রুপো
গলিয়ে ফেলেছে! গলানো সেই রুপো ঢেউ হয়ে ক্রমাগত যেন
জন্ম
দিচ্ছে
এক একটি কবিতার।
লিখছেন দেবাশিস দাশ |
|
|
এক দিকে দিনান্তের রাঙা সূর্য আবির ছড়িয়ে দিচ্ছে দামোদরের জলে। আর উল্টো দিক পূর্ব দিগন্তে পাহাড়ের কোল থেকে উঁকি দিচ্ছে কোজাগরীর নিটোল চাঁদ। এক দিকে সূর্য আর এক দিকে চাঁদের এই যুগলবন্দিতে আত্মহারা প্রকৃতিকে দেখে নৌকায় বসা আমরা ক’জন তখন প্রায় বাগ্রুদ্ধ।
বিস্ময়ের বুঝি বাকি ছিল আরও। যখন মাইথন জলাধারের চার দিকে ঝাঁপিয়ে সন্ধ্যা নামল। অন্ধকারে গভীর হল চাঁদের আলো। দেখলাম বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা দিগন্তবিস্তৃত দামোদরের জলে কে যেন রুপো গলিয়ে ফেলছে। আর সেই গলানো রুপো ঢেউ হয়ে ক্রমাগত যেন জন্ম দিচ্ছে এক একটি কবিতার! দূরে নদীর বুকে নিরলস ভাবে শুয়ে থাকা কচ্ছপের পিঠের মতো দ্বীপগুলিও চাঁদের আলোয় আরও মায়াবী হয়ে উঠেছে। রাত যত বেড়েছে জ্যোৎস্না যেন আরও গভীর হয়েছে বরাকরের বুকে। নিস্তব্ধ চরাচর জুড়ে শুধু রয়ে গিয়েছে প্রকৃতির অনন্য মেদুরতা।
|
|
হাওড়া থেকে ভোর সওয়া ৬টার কোলফিল্ড এক্সপ্রেসে চেপে বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ পৌঁছেছিলাম কুমারডুবি স্টেশন। সেখান থেকে অটোয় মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে মাইথনে যেতে ভাড়া লেগেছিল ১৫০ টাকা। অটোয় চেপে ভাঙাচোরা রাস্তা আর আবর্জনায় ভরা ঘিঞ্জি শহর দিয়ে যেতে যেতে মনে হয়েছিল, প্রায় চার ঘণ্টার ট্রেনপথ পেরিয়ে এ কোথায় এলাম! কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যেই বদলে গিয়েছিল ধারণাটা। মনে হয়েছিল হাওড়া থেকে মাত্র ২২৮ কিলোমিটার দূরে এমন একটা সুন্দর জায়গায় আগে আসিনি কেন?
হাওড়া থেকে ভোর সওয়া ৬টার কোলফিল্ড এক্সপ্রেসে চেপে বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ পৌঁছেছিলাম কুমারডুবি স্টেশন। সেখান থেকে অটোয় মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে মাইথনে যেতে ভাড়া লেগেছিল ১৫০ টাকা। অটোয় চেপে ভাঙাচোরা রাস্তা আর আবর্জনায় ভরা ঘিঞ্জি শহর দিয়ে যেতে যেতে মনে হয়েছিল, প্রায় চার ঘণ্টার ট্রেনপথ পেরিয়ে এ কোথায় এলাম! কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যেই বদলে গিয়েছিল ধারণাটা। মনে হয়েছিল হাওড়া থেকে মাত্র ২২৮ কিলোমিটার দূরে এমন একটা সুন্দর জায়গায় আগে আসিনি কেন?
অটোরিকশা যখন শহরের পথ ছেড়ে মাইথনের পথ ধরল তখন আচমকাই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। কোথায় ভাঙাচোরা রাস্তা, কোথায় বা ঝুল, ধোঁয়া? চোখের সামনে প্রকৃতি যেন ঢেলে দিয়েছে নিজেকে। দেখি হেমন্তের নীল আকাশের নীচে দামোদরের আদিগন্ত ধূসর জল। আর তার ওপর গজিয়ে ওঠা এক একটা সবুজ দ্বীপ যেন নারীর অলঙ্কার! সেই অলঙ্কারের পিছনে আবার উঁকি দিচ্ছে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ। ঠিক ছবির মতো। কী শান্ত, স্নিগ্ধ গোটা মাইথন!
যাঁরা শহর থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে কয়েক দিন শান্তিতে কাটাতে চান তাঁদের অন্যতম গন্তব্য হতে পারে মাইথন। মাইথন কথাটা এসেছে স্থানীয় মানুষের ভাষায়, মায়ের থান, অর্থাৎ মায়ের বাড়ি থেকে। কারণ, মাইথনেই রয়েছে বিখ্যাত কল্যাণেশ্বরীর মন্দির। সারা বছর মানুষ এই মন্দিরে পুজো দেন। অনেকেই ‘রথ দেখা কলা বেচা’র মতো ঘুরে যান মাইথন জলাধারও। |
|
কিন্তু মাইথনের প্রকৃত রূপ দেখতে গেলে, এর অপূর্ব স্নিগ্ধতাকে পূর্ণ ভাবে অনুভব করতে গেলে আপনাকে কোনও চাঁদনি রাত বেছে নিতে হবে। ভরা পূর্ণিমায় হাঁটতে হবে পাহাড়ি পথে। হাঁটতে হবে সেই লাল মোরাম বিছানো চড়াই-উৎরাই পথে যে পথ গিয়েছে নদীর ধারে। সেখানে দু’দণ্ড বসলেই যেন শুনতে পাবেন নদীর গান। অথবা চাঁদের আলো মেখে ভেসে পড়তে পারেন ডিঙি নৌকায়। দেখতে পারেন পাহাড় আর অরণ্যের মাঝে আটকে যাওয়া দামোদরের জল কেমন করে গলানো রুপো হয়ে গিয়েছে! তা-ও যদি না ভাল লাগে চলুন দামোদরকে বেঁধেছে যে জলাধার সেই ১৫ হাজার ৭১২ ফুট লম্বা ও ১৬৫ ফুট উঁচু জলাধারের চওড়া পিচের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি। যেমন আমরা ছ’জন মিলে হেঁটেছিলাম গত কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয়।
শুধু রাতই বা কেন, দিনের বেলাতেও আপনার ভ্রমণের ষোলকলা পূর্ণ হতে পারে। ভোর হলেই বেরিয়ে পড়তে পারেন পাহাড়ি পথ ধরে নানা পাখির গান শুনতে শুনতে ঈগল পয়েন্ট দেখতে। প্রায় দেড় হাজার ফুট ওপর থেকে দেখে নিতে পারেন পুরো মাইথন জলাধারটিকে।
সেখান থেকে উৎরাই পথে নেমে পড়ুন নদীতটে। সেখানে ব্যবস্থা রয়েছে বোটিংয়ের। চেপে পড়তে পারেন দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন অনুমোদিত ডিঙি নৌকা বা স্পিড বোটে। ঘুরে আসতে পারেন নদীর বুকে গজিয়ে ওঠা সবুজ দ্বীপ বা আনন্দ দ্বীপে। নির্জন দ্বীপে বেশ কিছুটা সময় কাটাতে পারেন। কপাল ভাল থাকলে দেখতে পারেন নদীর ওপারে পাহাড়ের পাদদেশে হওয়া সিআইএসএফের জওয়ানদের রাইফেল শুটিং।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মাছ ধরাও দেখতে যেতে পারেন। নদীতটে গেলেই দেখবেন দূরে নদীর বুকে সাদা রং করা ছোট ছোট নৌকায় চেপে জাল ফেলে মাছ ধরছেন মাঝিরা। চাইলে সস্তায় মিলে যেতে পারে সদ্য নদী থেকে তোলা মৌরলা, পুঁটি, খলুই, ট্যাংরা। হোটেলে ফিরে হোটেলের পাচককে অনুরোধ করলে মিলতে পারে গরম গরম মাছ ভাজা। এই অভিজ্ঞতা পাবেন কোথায়?
গাড়ি নিয়ে গেলে মাইথনে দু’দিক দিয়ে ঢোকা যায়। যেমন আসা যায় দিল্লি রোড হয়ে ঝাড়খণ্ড দিয়ে। আবার আসা যায় দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে বর্ধমান দিয়ে। তবে নিরাপত্তার জন্য বড় ট্যুরিস্ট বাস ঝাড়খণ্ডের দিক দিয়ে বাঁধে ঢুকতে দেন না ডিভিসি কর্তৃপক্ষ। এ জন্য নদীতটে বনভোজন করতে হলে আসতে হয় বর্ধমান, আসানসোল দিয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে। ইচ্ছে হলে মাইথনকে কেন্দ্র করে ঘোরা যায় পাঞ্চেৎ জলাধার, গড়পঞ্চকোট।
|
কী ভাবে যাবেন |
হাওড়া থেকে ট্রেনে বরাকর বা কুমারডুবি স্টেশন। দু’জায়গা থেকেই অটো
রিকশা
বা ট্রেকার পাবেন।
আসানসোলে নেমে সেখান থেকে সরাসরি
মাইথন যাওয়ার বাস ও অন্যান্য গাড়ি পাওয়া যাবে। |
কোথায় থাকবেন |
মাইথন গেলে আগে থেকে হোটেল বা হলিডে হোম বুক করে যাওয়াই ভাল।
কারণ এর
সংখ্যা
খুবই কম।
মাইথনে রয়েছে ডিভিসির নিজস্ব হলিডে হোম মজুমদার নিবাস।
এ ছাড়া,
বন
দফতর
ও রাজ্য পর্যটন দফতরের
একটি বাংলো রয়েছে পাড়ের উপরে।
আর
আছে
রাজ্য সরকার অনুমোদিত হোটেল শান্তিনিবাস। |
|
|
|
ছবি: দেবব্রত ঘোষ ও শৈলেন সরকার |
|