|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
রোম্যান্সের মুকুট আজও শাহরুখের |
যশ চোপড়া একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করলেন এই ছবিতে। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় |
আল্টিমেট লভ স্টোরি। ‘জব তক হ্যায় জান’ ছবিটার সঙ্গে এই ট্যাগলাইনটাই জোড়া হয়েছিল গোড়া থেকে। নিজের মৃত্যুর পূর্বাভাস নিশ্চয়ই যশ চোপড়ার কাছে ছিল না। কিন্তু ‘জব তক’-ই যে তাঁর শেষ ছবি হবে, এটা ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায়, প্রেমের গল্প বলতে ওস্তাদ মানুষটি ঠিক করে নিয়েছিলেন, তাঁর আর যা কিছু বলা বাকি আছে, সেটা তিনি এই ছবিতেই বলে নেবেন।
কী কী বলার ছিল যশের? জানার জন্য ‘জব তক হ্যায় জান’ দেখতে হবে।
অনেক পুরনো কথা মনে পড়বে, অনেক পুরনো স্মৃতি। চেনাজানা সেই অলিগলির মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনি হয়তো একটা নতুন মোড়ে এসে দাঁড়াবেন। বুঝতে পারবেন, হর রিস্তে কা এক ওয়ক্ত হোতা হ্যায়..। বুঝতে পারবেন, আল্টিমেট এই উপলব্ধিতে পৌঁছনোর জন্য আরও এক বার ফেলে আসা রাস্তাগুলো দিয়ে হাঁটা জরুরি ছিল।
ফেলে আসা রাস্তা মানে? যশের নিজের পুরনো ছবি, সমসাময়িক অন্য ছবিও...। ‘জব তক’-এ সচেতন ভাবেই ‘বীর জারা’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, ‘ডিডিএলজে’, ‘কভি আলবিদা না কহেনা’... বহু ছবির রেফারেন্স আছে। আছে ‘টাইটানিক’। এমনকী মা ছেড়ে চলে গিয়ে অন্য এক জনের সঙ্গে থাকেন, সন্তান সেটা মেনে নিচ্ছে একটা সময় ‘জব উই মেট’-ও মনে পড়তে পারে। বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের অফিসারের বেশে শাহরুখের চেহারাটা তো পুরো ‘চক দে ইন্ডিয়া’-র কবীর খান। |
|
জব তক হ্যায় জান
শাহরুখ, ক্যাটরিনা, অনুষ্কা |
এই সমস্ত রকম চেনা এবং চর্চিত উপাদানগুলো ব্যবহার করেই যশ এবং আদিত্য (ছবির গল্প আদিত্যর। চিত্রনাট্যে আদিত্য এবং দেবিকা ভগত) বদলে যাওয়া সময়টার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন।
অর্থাৎ? ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কামিং অফ এজ’, যশ চোপড়া রোম্যান্সে ‘জব তক’ হচ্ছে তা-ই। যে মহাকাব্যিক প্রেমগাথা যশ চোপড়া এত দিন ধরে বলে এসেছেন, ‘ইনস্ট্যান্ট মেক আউট, ইনস্ট্যান্ট ব্রেক আপ’ প্রজন্মের কাছে, সেক্স সংক্রান্ত ট্যাবু থেকে বেরিয়ে আসা প্রজন্মের কাছে তার কোনও মূল্য আছে কি? থাকলে কী ভাবে আছে? যশ এই উত্তরটাই খোঁজার চেষ্টা করেছেন এই ছবিতে। এবং সেই জন্যই বলে দিয়েছিলেন, এটাই তাঁর শেষ ছবি হতে যাচ্ছে।
একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে। একটা প্ল্যাটফর্ম সিকোয়েন্স আছে। দেখলেই ‘ডিডিএলজে’ মনে পড়তে বাধ্য। সেখানে কী ছিল? কাজল এগিয়ে যাচ্ছেন। আর শাহরুখ
বিড়বিড় করে চলেছেন, পলট পলট, পলট...। কাজল ঘুরে তাকাবেন কি না, তার উপরেই সব কিছু নির্ভর করছে। তাই তো? এখানে শাহরুখ ক্যাটরিনাকে বলছেন, “তোমাকে যদি চুমু খাই, আর তুমি যদি আমাকে থাপ্পড় না মারো, তা হলে তুমি আমাকে ভালবাসো।”
এবং এবং এবং...শাহরুখ চুমু খাচ্ছেন ক্যাটরিনাকে! ‘দিল তো পাগল হ্যায়’-এর ‘আউর পাস, আউর পাস’ সিকোয়েন্স-এর মতো শেষ মুহূর্তে কাট করে গানে চলে যেতে হচ্ছে না! যশ চোপড়ার এই ছবিতে চুমুটা খাওয়া যাচ্ছে, আলতো করে হলেও ঠোঁটে ঠেকানো যাচ্ছে ঠোঁট! দেখানো যাচ্ছে বিছানা! আর হ্যাঁ, যশ চোপড়ার নায়িকাও সিগারেট খেতে শিখেছে!
যশ তো চিরকালই এমন এক জন পরিচালক, যিনি প্রতি মুহূর্তে সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। পাঁচ দশকের কেরিয়ারে যশের মাইলস্টোনগুলো দেখলেই হিন্দি ছবির বাঁক বদলগুলো পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়! ‘ধুল কা ধুল’, ‘ওয়াক্ত’, ‘দিওয়ার’, ‘সিলসিলা’, ‘চাঁদনি’, ‘ডর’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’...এক-একটা ছবি এক-একটা দশকের সিলমোহর যেন! এক-একটা সময়ের চিহ্ন।
২০১২-র ‘জব তক’ এই সিলসিলা-য় আর একটা ঐতিহাসিক ছবি, কারণ এই ছবি বলিউড রোম্যান্সের আর একটি বাঁকের দলিল।
একটা বাঁক? নাকি একাধিক? যশ আর নেই। আদিত্য আছেন। ‘আল্টিমেট লভ স্টোরি’ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর আদিত্যর ছবির ভাষাই বা কী রকম হতে যাচ্ছে আগামী দিনে, দেখার থাকবে কিন্তু।
আর এক জনকেও দেখার থাকবে। তিনি ৪৭ বছরের শাহরুখ খান। চোপড়া ঘরানার এপিক রোম্যান্সে গত দু’দশকের পোস্টার-বয় তিনি (কর্ণ জোহরও স্টাইলগত ভাবে ওই ঘরানারই শিষ্য)। কিং অফ রোম্যান্সের মুকুটটি এখনও তাঁর দখলে আছে কি না, শাহরুখের কাছে এই ছবিটা ছিল তার লিটমাস-টেস্ট। শাহরুখ প্রাণ ঢেলে অভিনয় করেছেন! খোদ অমিতাভ বচ্চন এমনি এমনি এটাকে ‘স্বদেশ’-এর পর শাহরুখের সেরা কাজ বলছেন না!
ছবিটাতে শাহরুখকে খুব সুপরিকল্পিত ভাবে ব্যবহারও করা হয়েছে। বিশেষত আর্মি অফিসারের বেশে শাহরুখকে অনবদ্য লেগেছে দেখতে। কমবয়সি চেহারাটাও বিশ্বাসযোগ্যতা খোয়ায়নি। তার চেয়েও বড় কথা হল, বয়সটা ঢাকার মরিয়া চেষ্টাই করা হয়নি।
শেষের দিকে একটা দৃশ্যে শাহরুখ অনুষ্কাকে বললেনও, “আমি আসলে এ জন্মে তোমার তুলনায় অনেকটা ওল্ড-ফ্যাশনড...।” কার সংলাপ এটা? যশের? শাহরুখের? নাকি দু’জনেরই?
কিং অফ রোম্যান্স একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করলেন এই ছবিতে। আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, পর্দার রোম্যান্সে তিনি সত্যিই রাজা। যে কোনও দিন। ‘জব তক’-এর পর এ বার শাহরুখের নতুন কোনও ইনিংস শুরু হওয়া উচিত।
ক্যাটরিনা আর অনুষ্কার কাছেও এই ছবিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কে কেমন করলেন? |
|
ক্যাটরিনাকে খুব সুন্দর দেখতে লেগেছে। ভাল নেচেছেন। শাহরুখের সঙ্গে রসায়নও জমেছে। কিন্তু নিজস্ব অভিনয়ে, বিশেষত দ্বিতীয়ার্ধে, আরও অনেক পরিণত পারফর্ম্যান্স প্রয়োজন ছিল। সত্যি বলতে কী, দ্বিতীয়ার্ধে ক্যাটরিনা ফিরে আসার পর থেকেই গল্পটা ঝুলে গেল। মেজাজটাও নেতিয়ে গেল। ছবিটা এমনিতেই প্রচুর লম্বা। তার মধ্যে ক্যাটরিনা আরও ঝোলালেন। তাঁর পাশে অনুষ্কা এতটাই সাবলীল যে, তফাতটা আরও বেশি চোখে পড়ছিল। মনে মনে চাইছিলাম, শাহরুখ-অনুষ্কার গল্পটা আরও খানিকটা এগোক। এগোল না। দু-দু’বার অ্যাক্সিডেন্ট, স্মৃতিভ্রংশ-টংশ এসে গিয়ে জট পাকিয়ে গেল। অজস্র সাহসী সম্ভাবনা নিয়ে গড়ে ওঠা গল্পটা আবার কনভেনশনালের ছকে
ঢুকে গেল।
এই ছবিতে পার্শ্বচরিত্রদের ভূমিকা যৎসামান্য। ঋষি-নীতু-অনুপম-সারিকা, সকলেই কম বেশি ক্যামিও। সেখানে শাহরুখের পাশে ছবিটা টেনে নিয়ে গিয়েছেন কিন্তু ডিসকভারি চ্যানেলে কাজ করা অনুষ্কাই। ওঁর লিপে ‘জিয়া রে জিয়া রে’ গানটাও ভাল লাগে। ইন ফ্যাক্ট এই গানটাতেই সুরকার এ আর রহমানকে চেনা যাচ্ছে। নইলে বাকি গানগুলোয় গুলজার বা রহমান কেউই নিজেদের সুনামের কদর রাখেননি। নেহাত অনিল মেটার ক্যামেরায় দৃশ্যায়নগুলো চমৎকার, তাই গানগুলো পর্দায় দেখতে খারাপ লাগে না। লন্ডন, লাদাখ, কাশ্মীর তিনটে লোকেশনই দারুণ।
তবে শেষ পর্যন্ত ‘জব তক...’ বসে দেখার জন্য গান বা লোকেশনের হাতছানি ততটা জরুরি থাকে না। যশের শেষ ছবি, শাহরুখের ম্যাজিক আর অনুষ্কার উচ্ছলতাই এ ছবি দেখার যথেষ্ট কারণ হওয়া উচিত। ছবির এন্ড টাইটেলে শ্যুটিং-এর সময় তোলা যশের টুকরো ছবিগুলো দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই একটা প্রতিষ্ঠানের শেষ! এ ছবি কতটা ব্যবসা দেবে, সেটা সময় বলবে। কিন্তু যশ-শাহরুখ যুগলবন্দির শেষ তেহাই হয়ে থাকল ‘জব তক’..। হর রিস্তে কা এক ওয়ক্ত হোতা হ্যায়..। |
|
|
|
|
|