আইনে বদল, ঋণখেলাপিদের সম্পত্তি নেওয়া কার্যত শিকেয় |
দেবজিৎ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
কেউ কথা রাখেন-ও!
যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মাস আষ্টেক আগে তমলুকের একটি সমবায় ব্যাঙ্ক ঋণখেলাপি চাষিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নোটিস দিলে মহাকরণে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনও কৃষকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না। যে আইনবলে ওই কাজে উদ্যোগী হয়েছিলেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ, সেটিও সংশোধন করা হবে বলে জানিয়ে দেন মমতা।
মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরেই রাজ্যের সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে গেল গেল রব উঠেছিল। বক্তব্য পুনর্বিবেচনা করার আবেদন জানিয়ে মমতাকে চিঠি দিয়েছিল রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্ক। একই আর্জি ছিল পশ্চিমবঙ্গে স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কারস কমিটিরও। এমনকী, সমবায় ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য দেয় যে সংস্থা, সেই নাবার্ড-এর প্রতিক্রিয়াও ছিল চড়া। তাদের বক্তব্য ছিল, ঋণ শোধ না করার প্রবণতা তৈরি হলে সমবায়গুলি দিনদিন রুগ্ণ হয়ে পড়বে। ঋণ আদায়ের ব্যাপারে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির হাত-পা বেঁধে দেওয়া হলে তার প্রভাব পড়বে গোটা ব্যাঙ্ক শিল্পে।
তাতেও অবশ্য চিঁড়ে ভেজেনি। মুখ্যমন্ত্রী নিজের বক্তব্যে অনড় থাকায় তাঁর ঘোষণাকে নির্দেশ বলে মেনে নিয়ে রাজ্য সমবায় দফতর সম্প্রতি ঋণখেলাপির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত সংক্রান্ত আইনের একটি বিধি সংশোধন করে চূড়ান্ত খসড়া জমা দিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে। |
কী আছে সেই খসড়া সংশোধনীতে? রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেছেন, দীর্ঘ দিন ঋণ শোধ না করা ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা ও সেই সম্পত্তি নিলাম করে অর্থ পুনরুদ্ধার করার যে সুযোগ রাজ্য সমবায় আইনে ১২২ নম্বর ধারার ১৯১ নম্বর বিধিতে আছে, মূলত সেটিরই সংশোধন আনা হয়েছে। ব্যাঙ্কের নোটিস পাওয়া থেকে নিলাম, এবং তার পরেও নিলামে ওঠা অর্থ শোধ করার যে সময়সীমা ঋণখেলাপিকে মূল বিধিতে দেওয়া আছে, সংশোধনীতে সেটা দ্বিগুণ, কোথাও বা তারও বেশি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নিলামের জন্য সেল অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রার অফ কোঅপারেটিভ সোসাইটিজের (আরসিএস) হাতে বেড়ি পরানো হয়েছে। সব শেষে সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, স্থানীয় স্তরে নিলামের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার পরে তা চূড়ান্ত করতে রাজ্য সরকারের অনুমতি নিতে হবে।
ঠিক এই কথাটাই বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি অফিসারদের একাংশ বলছেন, কৃষকের জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই ক্ষমতায় এসেছেন মমতা। তাঁর সেই ‘রাজনৈতিক’ অবস্থান বজায় রাখতেই খসড়া সংশোধনী তৈরি করেছে সমবায় দফতর। এবং ওই সংশোধনী মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে আর কোনও সরকারি অফিসার বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম করার অনুমতি দেওয়ার সাহস দেখাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে সমবায় কর্তারাই। তাঁরা মনে করছেন, সে ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরই শেষ কথা বলবে।
সমবায় আইনের মূল বিধি অনুযায়ী, বকেয়া মেটানোর দাবিপত্র পাঠানোর পরে মতামত জানানোর জন্য ঋণখেলাপিকে তিন মাস সময় দেবেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। তিনি কোনও প্রশ্ন না তুললে বন্ধকী সম্পত্তি নিলামের জন্য ‘সেল অফিসার’ নিয়োগ করা হবে। ওই অফিসারই দ্বিতীয় চিঠি পাঠাবেন ঋণখেলাপিকে। তাতে সম্পত্তি নিলামের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে না, কেবল ওই প্রক্রিয়া শুরু করার ইচ্ছেটুকু প্রকাশ করা হবে। এখানেও ফের এক মাস সময় পাবেন ঋণখেলাপি। মূল বিধিতে বলা আছে, নিলামের দিন ঘোষণা ও তা কার্যকর করার মধ্যে অন্তত ১৫ দিনের ব্যবধান থাকতে হবে। আইনের ফাঁক গলে (যে হেতু অন্তত শব্দের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই) সংশোধিত খসড়ায় এখানে অনেকটাই সময় বাড়িয়ে দিতে চাইছে সরকার।
সমবায় আইন বলছে, নিলামে কেউ সর্বোচ্চ দর হাঁকলেই তাঁর হাতে বন্ধকী সম্পত্তি তুলে দেওয়া যাবে না। সম্পত্তির মালিকানা ফেরত পেতে ঋণখেলাপিকে আরও এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে। শর্ত একটাই, সর্বোচ্চ দরের উপরে ১০ শতাংশ বাড়তি টাকা দিতে হবে তাঁকে। যিনি সর্বোচ্চ দর ডেকেছেন, ক্ষতিপূরণ হিসেবে ওই টাকা তাঁকে দিতে হবে। সমবায় কর্তারা বলেন, “এ ভাবেই প্রতি ধাপে ঋণখেলাপিকে অর্থ শোধের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর পরে কেউ যদি বুঝে যান যে বছরের পর বছর টাকা ফেলে রাখলেও কিছু হবে না, তা হলে অচিরেই বহু সমবায় বন্ধ হয়ে যাবে।” |
ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর সঙ্গে নিলাম প্রক্রিয়ায় আরসিএসের ক্ষমতায়ও রাশ টানা হয়েছে খসড়ায়। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “মূল বিধিতে যে কোনও ব্যক্তিকে সেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আরসিএসকে। কিন্তু খসড়া সংশোধনীতে শুধু সরকারি আধিকারিককেই সেল অফিসার করার কথা বলা হয়েছে। এক সমবায় কর্তার ব্যাখ্যা, “সাধারণ ভাবে সমবায়ের পরিচালন কমিটির সদস্যদের ওই দায়িত্ব দেওয়া হত। তাঁরা সংস্থার স্বার্থই বেশি দেখতেন। সেল অফিসার সরকারি কর্মী হলে নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে।”
কী হবে, তা ভবিষ্যতই বলবে। তবে খসড়া সংশোধনী চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ঋণখেলাপিদের চিঠির ধাক্কায় জেরবার সমবায় কর্তারা। ক্যানিংয়ের এক ব্যক্তি লিখেছেন, সরকার বলেছে, ঋণ না শুধলেও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না। অথচ, স্থানীয় একটি সমবায় তাঁর উপরে চাপ সৃষ্টি করছে। চিঠির শেষে সংশ্লিষ্ট সমবায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন ওই ঋণখেলাপি। এক সমবায় কর্তা জানান, আরামবাগের এক বাসিন্দা তাঁর সমবায়ের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন মহাকরণে। সেই প্রতিলিপি দেখিয়ে সমবায়ের উপরে চাপ দিচ্ছেন।
সেই চাপের মুখে রাজ্যের বহু সমবায়ে ঋণ আদায় কার্যত বন্ধ রয়েছে বলে খবর। ওই তালিকায় রয়েছে তমলুকের সেই সমবায়ও, বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে যাদের নোটিস দেওয়াকে কেন্দ্র করে এত বিতর্ক। ওই ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান নিকুঞ্জ দাস বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে বকেয়া আদায় বন্ধ। চিঠি পেয়েও অধিকাংশ ঋণখেলাপি চুপ করে বসে আছেন।”
তাঁরা কারা? নিকুঞ্জবাবু বলেন, “গরিবরাই ঋণ শোধ করছেন। টাকা ফেলে রেখেছেন বরং অনেক সম্পন্ন চাষিই।” সমবায় কর্তাদেরও একই বক্তব্য। তাঁরা বলছেন, বহু ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ ধনী ঋণখেলাপিদের সম্পত্তির খুঁটিনাটি জানিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? উত্তর জানা নেই সমবায় কর্তাদের। |