দুবরাজপুরের ক্ষত শুকানোর আগেই তেহট্টে উত্তেজিত গ্রামবাসীদের সামলাতে গুলি চালাল পুলিশ। তাতে মৃত্যু হল এক গ্রামবাসীর। গুরুতর আহত আরও এক।
এক টুকরো সরকারি জমিতে অনুষ্ঠান করার দাবিতে ক’দিন ধরেই উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল নদিয়ার এই প্রান্তিক শহরে। মঙ্গলবার রাতে আলোচনা করে সেই সমস্যা সমাধান করে ফেলা হয়েছিল বলেই দাবি পুলিশের। কিন্তু ক্ষোভ যে মেটেনি, তা বোঝা যায় বুধবার সকালে। হাউলিয়া মোড় অবরোধ করেন আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা। দাবি ওই জমিতে অনুষ্ঠান করা নিয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে।
অবরোধ ঘিরে পরিস্থিতি ক্রমেই তপ্ত হতে থাকে। পুলিশের দাবি, হাউলিয়া মোড়ে আক্রান্ত হন তেহট্টের মহকুমা পুলিশ অফিসার (এসডিপিও)। তিনি কোনওমতে একটি বাড়ির ছাদে উঠে পড়েন। হামলা হয় এসডিপিও-র বাড়িতেও। উত্তেজিত জনতাকে থামানোর আর কোনও উপায় না থাকায় গুলি চালাতে হয় বলেই দাবি করছেন পুলিশ কর্তারা। মহাকরণে রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বলেন, “বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি করেছে।” যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশ আগে কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট ব্যবহার করেনি। এ সবই ছোড়া হয় গুলি চালানোর পরে। ফলে গুলি চালানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।
পুলিশের গুলিতে গুরুতর জখম স্থানীয় বাসিন্দা অশোক সেন (৪৫) হাসপাতালের পথেই মারা যান। সুধাময় ঘোষ নামে আর এক জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে এনআরএস হাসপাতালে। |
এ দিন মহাকরণে আসেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তেহট্টের ঘটনা জানতে পেরে তিনি নির্দেশ পাঠান, লিখিত বিবৃতি নয়। সাংবাদিক সম্মেলন করেই ঘটনার কথা জানানো হবে। সরকারের বক্তব্য কী হবে তা নিয়ে প্রশাসনের কর্তারা আলোচনা করেন। সুরজিৎবাবুকে পাঠানো হয় সাংবাদিক বৈঠকে।
সুরজিৎবাবু সরকারি বক্তব্য জানানোর আগেই অবশ্য পুলিশের গুলি চালানোর ‘ব্যাখ্যা’ দিয়ে দিয়েছিলেন নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, “ওখানে আত্মরক্ষার্থেই পুলিশ গুলি চালিয়েছে।” এর কিছুক্ষণ পরে সুরজিৎবাবু বলেন, “প্রায় শ-পাঁচেক মানুষ মারমুখী হয়ে তেহট্টের মহকুমা পুলিশ অফিসারের বাড়িতে হামলা চালায়। তখন বাড়িতে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও এক বছরের শিশু। তাঁরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। জনতাকে ঠেকানো যাচ্ছিল না। হাউলিয়া মোড়ে এসডিপিও-র উপর হামলা হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় অন্তত তিনটি পুলিশের গাড়ি। পুলিশ বাধ্য হয়ে তিন রাউন্ড গুলি চালায়।” ওই পুলিশকর্তার দাবি, এ দিন সংঘর্ষে আট পুলিশ কর্মী আহত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ে তদন্ত হবে বলেও জানান তিনি। কিন্তু তদন্ত শুরুর আগেই পুলিশ যে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া গেল কী করে? সুরজিৎবাবুর কাছে অবশ্য এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই জেলা পুলিশ সুপার ও জেলাশাসকের কাছে ঘটনার রিপোর্ট তলব করা হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পরেই নদিয়ার পুলিশ-প্রশাসনের একাধিক কর্তাকে বদলি করা হতে পারে। এসডিপিও-র ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ঘটনার পরেই তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় নেতা গৌরীশঙ্কর দত্ত দাবি করেন, “হতাহতেরা সকলেই আমাদের দলের সমর্থক।” তবে এ দিন বিকেলে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় মেনে নেন, মৃত কিংবা আহত কেউই তাঁদের সমর্থক নন। তিনি বলেন, “ওঁরা নিছকই সাধারণ মানুষ। তবে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কাদের উস্কানিতে ওই ঘটনা ঘটল তা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।”
বিজেপি-র নদিয়া জেলা সভাপতি কল্যাণ নন্দীর দাবি, “মৃত অশোকবাবু আমাদের দলীয় কর্মী। তৃণমূলের প্ররোচনাতেই পুলিশ এ দিন গুলি চালিয়েছে।” রেল প্রতিমন্ত্রী কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীও রাজ্য সরকার ও পুলিশকে বিঁধতে কসুর করেননি। তিনি বলেন, “রাজ্য সরকার পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। পুলিশ ক্রমশ ট্রিগার হ্যাপি হয়ে যাচ্ছে।” বিরোধী দলনেতা সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “প্রশাসন অনমনীয় মনোভাব নিয়েছে। গুলি চালানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না।” |
তেহট্টের পিডব্লিউডি মোড়ে লম্বাটে এক টুকরো জমির দখল নিয়েই দু’দল বাসিন্দার মধ্যে বিরোধ দানা বাঁধছিল কিছু দিন ধরে। জমির মাঝ বরাবর রাস্তা করা নিয়েই বিরোধের সূত্রপাত। মাস কয়েক আগে ওই জমিতে অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। তাদের দাবি, সরকারি নির্দেশ শেষ পর্যন্ত মেনেও নিয়েছিল দু’পক্ষ।
তবে এলাকায় এ নিয়ে চাপা অসন্তোষ জমছিল বলে জেলা গোয়েন্দা দফতর সূত্রে দাবি। প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, গোপনে তদন্ত করে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল স্বরাষ্ট্র দফতরে। তাই জমি-বিতর্ক মিটে গিয়েছে বলে পুলিশের একটা অংশ দাবি করলেও তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন জেলা পুলিশের পদস্থ কর্তাদের একাংশ। জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্তাও জানান, এ দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘এগ্জিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট’ স্তরের অফিসারকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল পুলিশ। তিনি পৌঁছনোর আগেই রক্তাক্ত হয়ে যায় ঘটনাস্থল। তাঁদের অভিযোগ, গোড়া থেকেই পুলিশের কিছু অফিসারের ‘সব সামলে নেব’ গোছের মনোভাবই বিপত্তির কারণ। |
ছবি:
কল্লোল প্রামাণিক, নিজস্ব চিত্র, নিহতের ছবি এবিপি আনন্দের সৌজন্যে |