পুলিশ হয় ভূত, নয়তো ভগবান। ভিতু বা ভক্ত কখনও ভাবছে, তিনি আছেন। কখনও ভাবছে, নেই। কলকাতার প্রাতর্ভ্রমণের বাতাবরণও কার্যত এমনই একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে। যেখানে পুলিশের থাকা আর না-থাকা নিয়েই দোলাচলে রয়েছেন স্বাস্থ্য ফেরাতে আসা অসংখ্য মানুষ।
কলকাতা পুলিশের দাবি, প্রাতর্ভ্রমণের জায়গাগুলিতে সাদা পোশাকের পুলিশকর্মী মোতায়েন থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, তাঁদের অস্তিত্ব কেউ টেরই পায়নি। বুধবার কাকভোরে রবীন্দ্র সরোবরেও একই ছবি। সেখানে দেখা গেল, কেউ নিজের নিরাপত্তার জন্য পকেটে লঙ্কাগুঁড়ো নিয়ে আসছেন। কেউ বা দেহরক্ষী হিসেবে সঙ্গে রাখছেন স্বামীকে। আবার কেউ পাশে কোনও স্বাস্থ্যবান যুবককে হাঁটতে দেখে ভাবছেন, ‘এ নিশ্চয়ই পুলিশ!’ ভাবনার গতিটা নানা দিকে বইলেও পরিণতিটা একই। অনিশ্চয়তা।
প্রশ্ন উঠছে, এমন চাপা উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা নিয়ে হেঁটে আদৌ কি কোনও লাভ হয়? স্বাস্থ্য ফেরে? চিকিৎসকেরা বলছেন, ফেরে না। চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র যেমন বললেন, “মর্নিং ওয়াক অনেকটা ধ্যানের মতো। শরীর-মন দুইয়ের জন্য উপকারী। এই সময়ে মনকে চাপমুক্ত না রাখলে শরীর ভাল হওয়ার আশা নেই।” |
এ দিন ভোরে রবীন্দ্র সরোবরে পৌঁছনোর পরে গোটা চত্বর ঘুরে এক জনও উর্দিধারী পুলিশকর্মীর দেখা মেলেনি। দেখা যায়নি পুলিশের কোনও ভ্যানও। প্রাতর্ভ্রমণকারীরা অনেকেই জানান, পুলিশি প্রহরা থাকে বলে তাঁরা শুনেছেন, কিন্তু দেখেননি। পেশায় স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক রাজরানী অগ্রবালের মুখে বিদ্রূপের হাসি। ‘‘পুলিশ? কোথায় পুলিশ? আশপাশে খুঁজে দেখুন তো, চোখে পড়ে কি না!’’ পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই এই চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন, “পকেটে ছোট প্যাকেটে লঙ্কাগুঁড়ো। আর আত্মরক্ষার জন্য ক্যারাটে বা ওই জাতীয় কিছু। নিদেনপক্ষে কষিয়ে একটা থাপ্পড় যাতে মারা যায়! আমি নিজে এটা মানি। আর চাই অন্যরাও মানুক।” অর্থাৎ, যাঁরা শারীরিক ভাবে দুর্বল, তাঁদের প্রাতর্ভ্রমণ না করারই প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন তিনি? রাজরানী বললেন, “তা কেন? যাঁরা ততটা চটপটে নন, আত্মরক্ষা করতে পারবেন না, তাঁদের কোনও রকম গয়না, এমনকী হাতে ঘড়িটা পর্যন্ত না পরা উচিত।”
সব গয়না বিসর্জন দিতে পারেননি বলেই লেক গার্ডেন্সের অভিরূপা হালদারকে ভোর-ভোর পাহারা দিতে আসেন তাঁর স্বামী চঞ্চল হালদার। পেশায় আইনজীবী চঞ্চলবাবু বললেন, “ও গলার সোনার চেন, কানের দুল বাড়িতে খুলে আসে। কিন্তু হাতে সোনার লোহা বাঁধানোটা সংস্কারবশে খোলে না। কোনও দিন হয়তো ওটার জন্যই প্রাণটা যাবে। তাই কাজ সেরে ঘুমোতে মাঝরাত হয়ে গেলেও আমি ভোরে উঠে ওকে সঙ্গ দিই।” স্বল্প উচ্চতার, ক্ষীণকায় চঞ্চলবাবুর দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি থাকলে ছিনতাইকারীদের হাত থেকে স্ত্রী নিরাপদ!
প্রাতর্ভ্রমণকারীদের মধ্যে ছিলেন মুম্বই থেকে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে আসা মৌলি দাশগুপ্ত। এক কালে মৌলি কলকাতাতেই থাকতেন। এখনও এই শহরে থাকলে চেনা রবীন্দ্র সরোবরে হাঁটতে ভালবাসেন। আত্মীয়ের পরামর্শে হার-দুল বাড়িতে খুলে বেরোলেও মৌলির ধারণা, “এত বড় একটা জায়গায় একেবারে নিরাপত্তা নেই, এটা হতে পারে না।”
সামান্য তফাতেই হাঁটছিলেন তৃষা চৌধুরী। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী তৃষা ফুট কাটলেন, “এখানে পুলিশ হল ভগবান কিংবা ভূতের মতো! সবাই মনে করছে আছে। কিন্তু কোথায়, তা কিন্তু কেউ জানে না।”
সামনেই হাঁটছিলেন ট্র্যাক প্যান্ট, টি-শার্ট পরা এক স্বাস্থ্যবান যুবক। তৃষা ফিসফিসিয়ে বললেন, “হতেও পারে উনিই পুলিশ। দেখে মনে হচ্ছে, স্বাস্থ্যরক্ষায় হাঁটছেন। আসলে হয়তো উনি আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যই হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হচ্ছেন!”
দেখা যাক বা না যাক, পুলিশ আছে! এমন প্রত্যয়ের কথা শোনালেন মধ্যবয়সী ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী। নিজের পরিচয় দিলেন কলকাতা পুলিশের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের স্ত্রী হিসেবে। স্বামীর নাম? “ওটা বলা বারণ। তবে পুলিশের কথা জানতে চাইছেন তো? পুলিশ সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দরকার হলেই সামনে আসবে।” বললেন নিরাভরণ ইন্দ্রাণীদেবী। হাত-কান-গলা কি খালিই রাখেন? “না, বাড়িতে খুলে রেখে এসেছি।” কেন? চারপাশে এত সাদা পোশাকের পুলিশ তো নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য রয়েছে! “হাঁটার সময়ে ও সব পরলে অসুবিধা হয়” বলতে বলতে হাঁটার গতি আচমকাই বাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলেন পুলিশ-পত্নী।
গল্প করতে করতে হাঁটছিলেন খুকু দত্ত আর রমা মিত্র। নিরাপত্তার প্রসঙ্গ ওঠায় মুহূর্তে বদলে গেল মুখের ছবিটা। খুকু বললেন, “ভোরের এই পরিবেশটা চমৎকার লাগত। খোলা জায়গা, এত গাছপালা, পাখির ডাক। ইদানীং হাঁটতে হাঁটতে সব সময়ে সতর্ক থাকি। পাশে কোনও অচেনা লোক হাঁটলে সন্দেহ হয়, লোকটা ছিনতাইবাজ নয়তো?’’ “সাদা পোশাকের পুলিশও তো হতে পারে! বরং সেটা ভাবাই ভাল।” হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলেন রমা। |