মিউচুয়াল ফান্ড |
কম ঝুঁকিতে ভাল লাভ
রোজগারের টাকা শেয়ার বাজারে খাটিয়ে একটু বাড়িয়ে নিতে চান।
কিন্তু ঝুঁকি নেওয়ায় প্রবল আপত্তি? তা হলে ইনডেক্স ফান্ডে লগ্নি করুন।
খরচ নামমাত্র হওয়ায় রিটার্নের প্রায় পুরোটাই আপনার লিখছেন নীলাঞ্জন দে |
|
|
আগের বার কথা দিয়েছিলাম ইনডেক্স ফান্ড নিয়ে বিশদে বলব। কারণ ওই ইক্যুইটি ফান্ডটি সম্পর্কে সকলের জেনে রাখা উচিত। বিশেষ করে এই মুহূর্তে শেয়ার বাজারের মুখ যখন উপরের দিকেই রয়েছে। মাঝে-মধ্যে সামান্য পতনে ধৈর্য না-হারালে মন্দ হচ্ছে না রিটার্ন।
সে বার বলেছিলাম সক্রিয় ভাবে পরিচালিত ফান্ড (অ্যাক্টিভ) ও নিষ্ক্রিয় ভাবে পরিচালিত ফান্ডের (প্যাসিভ) কথা। সব ইনডেক্স ফান্ডই হল ওই প্যাসিভ ফান্ড। সব প্যাসিভ ফান্ড অবশ্য ইনডেক্স ফান্ড নাও হতে পারে। যাই হোক, ইনডেক্স ফান্ড অত্যন্ত উঁচু মানের। রিটার্ন দেওয়ার ক্ষমতা সীমাহীন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বেশির ভাগ লগ্নিকারীর কাছে ব্রাত্য। কারণ, একে সে ভাবে তুলেই ধরা হয় না। আসলে মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে ইনডেক্স ফান্ড ও ইনডেক্সিং (সূচক ভিত্তিক লগ্নি সংক্রান্ত নানা বিষয়) সম্পর্কে বহু লগ্নিকারী জানেনই না।
|
ইনডেক্স ফান্ডের অ আ ক খ |
ইনডেক্স বা সূচকের অর্থ না-বুঝলে, এই ফান্ডের মানেটা কিন্তু গুলিয়ে যাবে। সূচক হল বাজারের গতিবিধির নির্দেশক। একটি সূচক তৈরি হয় সেই সব শেয়ার নিয়ে, যাদের ওঠাপড়া বাজারের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। সূচকের আওতায় কেনা-বেচা চলে ওই শেয়ারগুলির। নানা কারণে তাদের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ে-কমে। আর সেই অনুপাতে বাড়ে-কমে সূচকের মূল্য। অর্থাৎ সূচক পয়েন্ট অর্জন করে বা খোয়ায়। পয়েন্ট বাড়লে লগ্নিকারীর লাভ। কমলে ক্ষতি।
যেমন, ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের জনপ্রিয় সূচক এসঅ্যান্ডপি সিএনএক্স নিফটি। গত ২০০২-র ৩১ অক্টোবর সূচকটি বন্ধ হয়েছিল ৯৫১.৪ পয়েন্টে। এক দশক পরে এ বছরের ৩১ অক্টোবর বাজার বন্ধের সময়ে তা দাঁড়িয়েছে ৫,৬১৯.৭ পয়েন্ট। ভেবে দেখুন, ১০ বছর আগে আপনি যদি ওই সূচকের শেয়ারে টাকা ঢালতেন এবং সেই লগ্নি এ বছর পর্যন্ত চালিয়ে যেতেন কী হত! ৩১ অক্টোবর হাতের শেয়ার বেচে আপনার সিন্দুকে ঢুকত তাক লাগানোর মতো অঙ্ক।
|
সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি |
সূচকের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক ইনডেক্স ফান্ডের। কোনও প্রতিযোগিতা নেই। হারিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্পৃহা নেই। বরং সূচকের ভাল-মন্দই এ ফান্ডের ভবিতব্য। কারণ এই ফান্ড সেই সব শেয়ারই কেনে, যেগুলির লেনদেন চলে ওই নির্দিষ্ট সূচকের আওতায়। ঠিক যে গুরুত্ব বা অনুপাতে বিভিন্ন শেয়ার নিয়ে তৈরি হয় সূচকটি, লগ্নির টাকাও সেই অনুপাতেই খাটানো হয়। অর্থাৎ সূচকে কোনও সংস্থার শেয়ার যতটা গুরুত্ব পায়, ফান্ড হুবহু সেই অনুপাতে শেয়ার কেনে।
নিফটি ইনডেক্স ফান্ডের কথাই ধরুন। এই ফান্ডের লগ্নি এসঅ্যান্ডপি সিএনএক্স নিফটি সূচকে। এর মধ্যে বিভিন্ন শেয়ার ঠিক যে গুরুত্ব নিয়ে যে অনুপাতে রয়েছে, একই অনুপাতে ফান্ড ওই সব শেয়ার কিনেছে। রিটার্ন পাওয়ার ক্ষেত্রেও ফান্ড সূচকটির গতিপ্রকৃতিকে অনুকরণ করেই এগোবে। ফলে নিফটি বাড়লে লগ্নিকারীর লাভ, পড়লে লোকসান।
|
ইটিএফ-ও এই দলে |
হালে লগ্নিকারীদের পছন্দের একটা বড় অংশ দখল করেছে ইনডেক্সিং। এর কৃতিত্ব পুরো মাত্রায় পেতে পারে এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড বা ইটিএফ। গোল্ড ইটিএফের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন। অনেকেরই খুব পছন্দের এটা। ইক্যুইটি ফান্ডের ক্ষেত্রে ইটিএফ বলতে বোঝায় সেই ইনডেক্স ফান্ড, যা বাজারে নথিভুক্ত শেয়ারের মতোই বেচা-কেনা করা যায়।
|
যে আছে উল্টো দিকে |
অ্যাক্টিভ ফান্ডের ক্ষেত্রে আবার হয় উল্টোটা। এ ক্ষেত্রে ফান্ড ম্যানেজারের একটাই চেষ্টা। কী করে ফান্ডের পারফরম্যান্স টেক্কা দেবে শেয়ার বাজারকে। এখানেও সমস্ত ফান্ডের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করা হয় তাদের জন্য বেছে নেওয়া সূচকের ভিত্তিতে।
|
ইনডেক্স ফান্ড-ই কেন! |
মুনাফা নিশ্চিত করতে যে-সব মিউচুয়াল ফান্ড সংস্থার তুরুপের তাস ইনডেক্স ফান্ড, তাদের যুক্তি খরচ কম, তাই লাভ বেশি। এ ফান্ডের প্রবক্তারা বলেন, রিটার্ন পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে বহু অ্যাক্টিভ ফান্ডই শেয়ার বাজারকে ছাপিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। ফলে ঝুঁকি বাড়ে। উপরন্তু, অ্যাক্টিভ ফান্ডে টাকা খাটাতে অনেক বেশি পরিকল্পনা করতে হয় বলে খরচও বেড়ে যায়। বাজার থেকে পাওয়া অর্থের বড় অংশই চলে যায় গবেষণা, বেতন ও পরিচালনার খরচ মেটাতে। মূল্যবৃদ্ধির এই জমানায় তা নেহাত কম নয়। ফলে রিটার্ন পাওয়ার সময় সব কেটেকুটে লগ্নিকারীর যা জোটে, তা প্রায় চোখেই দেখা যায় না। কিন্তু ইনডেক্স ফান্ডে ঝুঁকি অনেক কম। পরিচালনার ঝক্কিও কম। মাথার চুল ছিঁড়ে ভাবনা-চিন্তা করতে হয় না। ফলে আনুষঙ্গিক খরচ অনেক কমে যায়। যা হাতে আসে, তার প্রায় পুরোটাই আপনার।
|
বেছে নিন সঠিক ফান্ড |
এখানেই আসে ‘ট্র্যাকিং এরর’-এর কথা।
আপনার ফান্ড বাছার অন্যতম শর্ত যেটি। যে ইনডেক্স ফান্ডের ট্র্যাকিং এরর সব থেকে কম, সেটাই আপনার জন্য সব থেকে ভাল ফান্ড। ‘ট্র্যাকিং এরর’ মানে, সূচকের সঙ্গে ফান্ডের পারফরম্যান্সের ফারাক। ফারাক যত কম রিটার্ন তত ভাল। অর্থাৎ ফান্ড তার সূচককে যত খুঁটিয়ে নকল করবে, ততই আপনার লাভ।
|
ভাবার সময় এসেছে |
বিশ্বের বহু উন্নত অর্থনীতিতেই জনপ্রিয় ইনডেক্স ফান্ড। ভারতে ততটা নয়। ইনডেক্সিং-এর ধারণাটাই আসলে এ দেশে খুব কম। তবে এখন দীর্ঘমেয়াদে অর্থ সঞ্চয়ের পথ হিসেবে কিন্তু ইনডেক্স ফান্ড নিয়ে আরও ভাবার সময় এসেছে। এই ফান্ডে সিস্টেম্যাটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান (এসআইপি)-ও করা যায়। বিশ্বাস করুন, এমন ভাল জিনিস আর হয় না। শেয়ার বাজারে লগ্নির কথা ভাবছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য এটা একটা দুর্দান্ত শুরু হতে পারে।
|
সমস্যা যেখানে |
এ দেশে বহু ওপেন এন্ডেড ইনডেক্স ফান্ড রয়েছে। ওপেন এন্ডেড ফান্ড বলতে বোঝায়, যার শেয়ার বছরের যে-কোনও সময়ে কেনা ও বেচা যায়। কিন্তু খুব কম সূচকে এই সুযোগ আছে। মাতামাতি হয় শুধু নিফটি ও সেনসেক্স নিয়েই। কিছুটা জনপ্রিয় ব্যাঙ্কিং সূচক। অথচ বিএসই ও এনএসই-তে বিভিন্ন ধরনের সূচকের ভিড়। এটা খুবই দুভার্গ্যজনক।
|
একনজরে |
• সূচকে যে ভাবে শেয়ার ছড়ানো থাকে, তাকেই নকল করে ইনডেক্স ফান্ড।
• পরিচালনার খরচ কম, তাই রিটার্ন বেশি (অ্যাক্টিভ ফান্ডের তুলনায়)।
• ঝুঁকি একেবারে নেই, তা অবশ্য বলা যাবে না। কারণ বাজার পড়লে ন্যাভ নামবে। |
মনে রাখলে ডুববেন না |
• কম খরচই এ ফান্ডের চমক
• আগেই খরচের কথা জেনে নিন।
• কোনওটির খরচ অস্বাভাবিক বেশি হলে, ধরে নিতে হবে সেটিতে সমস্যা আছে।
• ট্র্যাকিং এরর নিয়ে সতর্ক থাকুন।
• সূচক যা রিটার্ন দিচ্ছে, ফান্ড হুবহু তা না-দিলে এরর বাড়তেই থাকবে।
• অ্যাক্টিভ ফান্ড মানে অর্থনীতির খুঁটিনাটি, শিল্পের পরিসংখ্যান, শেয়ার সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে নাড়াঘাঁটা এই খাটনি নেই ইনডেক্স ফান্ডে।
• অ্যাক্টিভ ফান্ড ম্যানেজাররা সহজেই ভুল করেন, লগ্নিকারীর চাপ বাড়ে।
• ইনডেক্স ফান্ডে ভুলভ্রান্তির সুযোগ কম।
• সূচককে অন্ধ ভাবে অনুকরণ করতেই হবে এই ফান্ডকে।
• সূচককে ছাপিয়ে যাওয়া চলবে না।
• শেয়ারগুলি মোট যা-রিটার্ন দেবে, চোখ বুজে তা-ই মিলবে ফান্ড থেকে। |
|
লেখক উইশলিস্ট ক্যাপিটাল অ্যাডভাইজর্সের ডিরেক্টর
(মতামত ব্যক্তিগত) |
|