মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে উল্লেখ রয়েছে কালীর। অশ্বত্থামা পাণ্ডব শিবির ধ্বংস করার পরে এই দেবী আবির্ভূত হন। তিনি বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন ওই শিবিরের পশুসকল। করুণ সুরে গান গাইছিলেন কোনও। তাঁর প্রস্থানের পরেই পাণ্ডব শিবির অধিকার করে রাক্ষস ও ভূত।
ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, বিকটদর্শনা এই দেবীর কণ্ঠে নরমুণ্ডের মালা, হাতে খড়্গ। তাঁর আরাধনা হয় সাধারণ ভাবে অন্য দেবীদের মতো করে নয়। পুজো শুরু হয় ভরা অমাবস্যার গভীর রাতে। সব উৎসব যখন দিনের আলোয় বা চন্দ্রালোকিত রাতে অনুষ্ঠিত হয়, তখন অমবস্যার মধ্য প্রহরে এই দেবীর উপাসনা বস্তুত তুলনারহিত। শতপথ ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণে কালীর প্রায় কাছাকাছি এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি নৈঋতি। পণ্ডিতেরা বলেন, নৈঋত কোণ থেকে নৈঋতির উল্লেখ। যেহেতু তিনি দিক নির্দেশ করেন, তাই তিনি দিগদেবী। আর তখন থেকেই তাঁকে রাত্রির দেবী বলেও মনে করে নেওয়া হতে শুরু করে। তবে এই দেবীর রং কালো। তিনি দিব্যরূপিনী। সম্ভবত প্রাগার্য এই দেবী শেষ পর্যন্ত বৈদিক পুণ্যচর্চায় নৈঋতি রূপে স্থান পেয়েছিলেন। তাঁর উৎপত্তি অস্ট্রিক বলেও মনে করেন পণ্ডিতেরা। ইন্দো-ইউরোপীয় পুরুষতান্ত্রিক পুণ্যচর্চায় এই দেবী আনন্দ পান রক্তে। এবং পুরুষ পশুর বলি নৈবেদ্য রূপে আশা করেন। তিনি অনেক সময় চণ্ডী ও দুর্গার মতো হন্তারূপেই পূজ্য দেবীদের রূপ বলেও বিবেচিত হন। তাঁদের চেয়েও বেশি ক্রুদ্ধ ও তেজী বলেও ভাবা হয়।
এই দেবীর সঙ্গে, চণ্ডীর মতোই ভূত ও রাক্ষসদের সম্পর্ক মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কের খাতিরেই এসেছে বলে মনে করেন পণ্ডিতেরা। বাংলার কিছু অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে, মহালয়ার তিথিতে যাঁরা উত্তরপুরুষের হাতে জল পাওয়ার আশায় মর্ত্যে আসেন, তাঁদের ফিরে যাওয়ার তিথি হল কৃষ্ণ চতুর্দশী। সেই জন্যই এই তিথিতে আলো জ্বালানো হয়। যাতে সেই আলো ধরেই তাঁরা ফিরে যেতে পারেন। সম্পূর্ণ বিপরীত মতও অবশ্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এই রাতেই পূর্বপুরুষেরা ফিরে আসেন সংসারে। তাঁদের পথ দেখাতে কিংবা মতান্তরে ভয় দেখাতে আলো জ্বালিয়ে রাখা হয় এই তিথিতে।
নবদ্বীপের বিখ্যাত তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ কালীর যে রূপ আমরা এখন দেখি, তা তৈরি করেছিলেন বলে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তবে মনে করা হয়, তাঁর সেই প্রতিমায় কালী ছিলেন একাই। পরে সম্ভবত শ্মশানের অনুষঙ্গে শব ও তারও পরে শিবের কল্পনা করা হয়েছে। কোনও পণ্ডিত সমাজের ধারণা, দুর্গা যখন বাঙালির ঘরের উমায় পরিণত হলেন, তখন শক্তিরূপা কোনও ভয়ঙ্কর মাতৃমূর্তির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কৃষ্ণানন্দের হাত ধরে সেই মূর্তি রূপ পায়। নদিয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্রের উৎসাহে কালীপুজো ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। ক্রমশ তা তাঁর সময়েই উৎসবের আকার নিয়েছিল।
এই দেবী সম্পদেরও দেবী। বৈদিক কাল থেকে তো বটেই, সাম্প্রতিক কালেও তাঁর সঙ্গে সম্পদের সম্পর্ক গঠিত হয়েছে।
কালো দেবী, অমাবস্যা, শ্মশানের অনুষঙ্গ, এই সব ঘিরে প্রচুর অলৌকিক কাহিনিরও প্রচার হয়েছে। স্বয়ং কৃষ্ণানন্দের পুজো ঘিরেই রয়েছে এমনই নানা কাহিনি। আগমেশ্বরী কালী এখনও সেই সব নিয়ম মেনেই পুজো করা হয়।
বল্লালদিঘির কালীপদ সরকার বাড়ির পুজোর ইতিহাস আড়াইশো বছরের। পুজোর পরদিন গ্রামের লোককে লুচি ভোগ খাওয়ানোর রীতি বহু দিনের। সেবার পুজোর মধ্য রাতে নামল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। সরকারগিন্নির মাথায় হাত। সব জ্বালানি কাঠ ভিজে গেল যে! হঠাৎ দেখেন ওই বৃষ্টির মধ্যেই সাদা কাপড় এক বৃদ্ধা প্রদীপ হাতে ফাঁকা জায়গায় পড়ে থাকা কাঠ সরাচ্ছেন। কিন্তু সেই বৃদ্ধা কে, তা আর অনেক খোঁজ করেও জানা যায়নি। এই কাহিনি এখনও লোকে বিশ্বাস করেন। |