শহর জুড়ে মোটরবাইক বাহিনীর ছিনতাইয়ের দাপট এবং বাধা দিলে বেপরোয়া আক্রমণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পুলিশের সামগ্রিক ব্যর্থতার ছবি। সেই খামতি এতটাই যে, শহর থেকে শহরতলিতে জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে এমন ১৩টি ছিনতাইয়ের পরেও সূত্র খুঁজতে কার্যত অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে পুলিশ। পদক্ষেপ বলতে এক কর্তাকে বদলি, যার পরে ফের একই কায়দায় ছিনতাই করে কার্যত পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে বাইক-বাহিনী। লালবাজারে বৈঠকের নির্দেশ মেনে টহলদারি ও চেকিং বাড়ানোর দাওয়াইয়েও যে কাজ হয়নি, স্পষ্ট সেটাও। মোটের উপরে নাগরিকদের অসহায়তাই যেন এখন কলকাতার রোজনামচা।
কসবা, যাদবপুর থেকে চিৎপুর, শহরের নানা প্রান্তে একের পর এক ছিনতাইয়ে তাই আতঙ্কিত শহরের মহিলারা। কেউ সাতসকালে মোটরবাইক দেখলেই আঁতকে উঠছেন। সোনার গয়না দূর অস্ৎ, নকল সোনার হার পরে বেরোতেও ভয় পাচ্ছেন অনেকে। মাসখানেক আগে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন যাদবপুরের চৈতালী দত্ত। ফাঁকা রাস্তায় তাঁর পথ আটকায় মোটরবাইক-আরোহী দুই যুবক। চৈতালীদেবীর কথায়, “ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা ‘কিছু নেই’ বলে চলে গেল।” এখন ভুলেও সোনার গয়না পরে রাস্তায় বেরোন না তিনি। কসবার বাসিন্দা অপর্ণা ঘোষ বলেন, “ঝুটো গয়না পরে বেরোতেও ভয় লাগে। যদি আসল-নকল না বুঝেই কোনও অঘটন ঘটিয়ে দেয়!”
ছিনতাইবাজদের দৌরাত্ম্যের সামনে কার্যত অসহায় কলকাতা পুলিশও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের পাকড়াও করতে পারেননি গোয়েন্দারা। বদলি হতে হয়েছে ছিনতাই দমন শাখার অতিরিক্ত ওসি প্রদীপকুমার ঘোষালকে। কিন্তু তার পরেই ফের ছিনতাই করে অপরাধীরা বুঝিয়ে দিয়েছে, এ সবে থোড়াই কেয়ার করে তারা। পুলিশের একাংশের বক্তব্য, এ যেন রঘু ডাকাতের চিঠি দিয়ে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছোড়া। বুঝিয়ে দেওয়া, ‘ক্যাচ মি, ইফ ইউ ক্যান।’
পুলিশের একাংশ বলছে, ছিনতাইয়ের ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু সম্প্রতি যে বেপরোয়া মনোভাব অপরাধীদের দেখা যাচ্ছে, সেটাই চিন্তায় ফেলেছে লালবাজারকে।
ছিনতাইবাজদের এই বেপরোয়া মনোভাবের প্রথম নজির কসবায়। ২৪ জানুয়ারি সেখানে বিদ্যা দেশাই নামে এক মহিলার হার ছিনতাই করে দুষ্কৃতীরা। বাধা দিতে গিয়ে তাদের ছোড়া গুলিতে জখম হন বিদ্যাদেবী। সেই ঘটনার বছর ঘুরতে চললেও জড়িতদের হদিস পাননি গোয়েন্দারা। তার পরে ২১ সেপ্টেম্বর যাদবপুরে এক বৃদ্ধার হার ছিনতাই করতে গিয়ে গুলি চালায় ছিনতাইবাজেরা। তার পরদিনই জোড়া ছিনতাই হয় ঢাকুরিয়ার বাবুবাগানে। এক মহিলার হার ছিনতাই করে পালানোর সময় তাঁকে লক্ষ করে পাঁচটি গুলি ছোড়ে দুষ্কৃতীরা। বরাতজোরে বেঁচে যান মহিলা। এর আগে-পরেও নানা জায়গায় ঘটে গিয়েছে ছোট-বড় ছিনতাই। শহরের বুকে পরপর এই ধরনের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে নাগরিকদের মধ্যে।
শহরের বাসিন্দাদের আতঙ্ক কাটাতে কোনও ‘দাওয়াই’ দিতে পারছে না পুলিশও। গোয়েন্দা দফতরের ছিনতাই দমন শাখা এবং ডাকাতি দমন শাখা যৌথ ভাবে অপরাধীদের খোঁজে নামলেও লাভ হয়নি। লালবাজারের একাংশের বক্তব্য, ইদানীং যে অপরাধীরা ছিনতাই করছে, তাদের সম্পর্কে কোনও তথ্যই জোগাড় করা যায়নি। দু’তিনটে ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া দুষ্কৃতীদের জেরা করে তাদের কয়েক জন সহযোগীকে পাকড়াও করা গিয়েছে মাত্র। তার বেশি কোনও সূত্র পাননি গোয়েন্দারা। প্রশ্ন উঠেছে, লালবাজারে গোয়েন্দাদের ‘সোর্স নেটওয়ার্ক’ নিয়েও। যদিও কলকাতা পুলিশের এক কর্তার দাবি, শহরে ছিনতাইয়ের পিছনে একাধিক দল রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। সম্প্রতি বন্দর এলাকা থেকে ধৃত তিন যুবক ও সোনারপুরের দুই যুবককে জেরা করে এই তথ্য তাঁরা পেয়েছেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, গত কয়েক মাসে লালবাজারের ‘ক্রাইম কনফারেন্স’-এ পুলিশ কমিশনার বিভিন্ন থানা এলাকায় মোটরসাইকেল ‘চেকিং’ এবং টহলদারি বাড়াতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তথ্য বলছে, কমিশনারের দাওয়াই শহরের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। পুলিশেরই একাংশের বক্তব্য, ক্রাইম কনফারেন্সে যে ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়, তা অপরাধ আটকানোর জন্য যথেষ্ট নয়। কী ব্যবস্থা নিলে এই ধরনের অপরাধ আটকানো যাবে, তারও হদিস দিতে পারেননি পুলিশকর্তারা। তবে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “ছিনতাইয়ের সংখ্যা বাড়েনি। অপরাধের ধরন বদলে গিয়েছে। ইদানীং অস্ত্র নিয়ে ছিনতাই করছে দুষ্কৃতীরা। এটাই চিন্তার বিষয়।” |