এক দিকে দরিদ্র পরিবারের অসহায়তা। অন্য দিকে, মানসিক রোগীর নিরাপত্তাহীনতা। এই দুইয়ের আবর্তে বন্দি মালদহের ইংরেজবাজারের নরহাট্টা পঞ্চায়েতের সাতঘরিয়া গ্রামের বৃদ্ধ কেরামত আলির জীবন।
আক্ষরিক অর্থেই বন্দি তিনি। রাত-দিন বিড়বিড় করে একা কথা বলেন। মেজাজ খারাপ হলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারধরও শুরু করেন। কামড়েও দেন। দিশেহারা দিনমজুর দুই ছেলে চিকিৎসার টাকা জোটাতে না পেরে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছেন বাবাকে। দু’এক দিনের ঘটনা নয়। প্রায় দু’বছর এ ভাবেই শিকল বাঁধা অবস্থায় কখনও গাছের তলায়, কখনও ঘরের দাওয়ায় দিন কাটছে ৭৩ বছরের ওই বৃদ্ধের।
মালদহ শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সাতঘরিয়া গ্রাম। মালদহ-রতুয়া রাজ্য সড়ক থেকে বাঁ দিকে ১০০ মিটার কাঁচা রাস্তা পেরোলেই চোখে পড়বে গাছের তলায় প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে এক বৃদ্ধ ভাত খাচ্ছেন। দূর থেকে অস্বাভাবিক কিছু ঠেকবে না। সামান্য এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে বৃদ্ধের একটি পা শিকল দিয়ে তালাবন্দি। শিকলের সঙ্গে মোটা দড়ি গাছের সঙ্গে বাঁধা। ভাত খেতে খেতে ফ্যালফ্যাল করে তাকান বৃদ্ধ। নাম জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেন না।
পাশেই দাঁড়িয়ে পরিজনেরা। তাঁরা জানান, ২০১০-এর গোড়ায় কেরামতের অসংলগ্ন কথাবার্তা ও আচরণ শুরু হয়। ছেলেরা তাঁকে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। মানসিক বিভাগে চিকিৎসা শুরু হয়। ওই বছরের শেষের দিকে তাঁকে বাড়ি ফেরানো হয়। বড় ছেলে নাজিমুদ্দিন শেখ বলেন, “ডাক্তারবাবুদের কথাতেই বাবাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু ফের আগের মতো পরিস্থিতি শুরু হয়।” |
পুরো সুস্থ হওয়ার আগেই কেন তাঁকে ছেড়ে দিল হাসপাতাল? মালদহ মেডিক্যাল কলেজের মানসিক বিশেষজ্ঞ পার্থ দাশগুপ্ত বলেন, “মানসিক রোগীদের সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। সাধারণত রোগীরা একটু সুস্থ হলে আমরা তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। বাড়িতে তাঁদের নিয়মিত যত্নের মধ্যে রাখতে হয়। কেউ আবার অসুস্থ হলে তাঁকে ফের ভর্তি করে চিকিৎসা করানো হয়। ওই বৃদ্ধ ফের অসুস্থ হলে পরিজনদের তাঁকে ভর্তি করতে বলা হলেও তাঁর বাড়ির লোকেরা করাননি।”
কেন আর চিকিৎসা করালেন না? নজিমুদ্দিনের জবাব, “অবস্থা খারাপ হলে ফের হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ডাক্তারবাবু বাইরে থেকে স্ক্যান করাতে বলেন। দিনমজুরি করে খাই। স্ক্যান করানোর টাকা কোথায় পাব? তাই বাড়িতেই এনে রেখেছি।” কেরামত আলির স্ত্রী ফাইমান বিবি বলেন, “তা ছাড়া, ছেলেরা যদি বাবাকেই সারা ক্ষণ সামলাবে, তা হলে দিনমজুরি করবে কখন?” তাঁর কথায়, “কেউ আটকে রাখতে পারে না। তাই শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি।”
তবে তাঁরাই প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই করবেন বলে এখন আশ্বাস দিয়েছেন মালদহ মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা। পার্থবাবু বলেন, “রোগীকে এখানে আনা হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।”
কেরামতের এই বন্দি জীবনের কথা অবশ্য জানেন এলাকার অনেকেই। কিন্তু কেউ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে এগিয়ে আসেনি। নরহাট্টা পঞ্চায়েতের কংগ্রেস প্রধান বিষাণ চৌধুরী বলেন, “ওই বৃদ্ধ মনোরোগী। কাছে গেলে মারতে আসেন। হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। বিডিওর কাছে সাহায্য চেয়েছি।” ইংরেজবাজারের বিডিও গোপালচন্দ্র দাস অবশ্য রবিবার শিকল বন্দি বৃদ্ধের কথা শুনে অবাক হয়ে বলেন, “ঘটনাটি জানতাম না। টাকার অভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে না এটা হতে পরে না। সোমবার ওই বৃদ্ধকে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করা হবে।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বিধান মিশ্রও জানান, কেউ কেরামতকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে স্বাস্থ্য দফতর থেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।
কেরামতের পরিবারের এখন ভরসা সেই আশ্বাসই। মানসিক রোগীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন রত্নাবলি রায়। তাঁর কথায়, “বার্ধক্যে মানসিক রোগ হতেই পারে। মানুষের গড় আয়ু যত বাড়বে মনোরোগীদের সংখ্যাও স্বাভাবিক ভাবেই বাড়বে। সকলে যাতে চিকিৎসা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের রাজ্যে মানসিক রোগীদের চিকিৎসার যে পরিকাঠামো রয়েছে, তৃণমূল স্তর থেকে তার বদল দরকার। এ বিষয়ে সরকারের ভাবনার অভাব রয়েছে।” |