মমতার পথে শিল্প কী ভাবে, সরব বুদ্ধ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ও তমলুক |
দুবরাজপুর এবং এবিজি বিতাড়ন নিয়ে এত দিন সরব ছিলেন দলের অন্য নেতারা। এ বার দু’টি ঘটনা নিয়েই মুখ খুললেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রশ্ন তুলছেন বর্তমান সরকারের জমি-নীতি নিয়ে। এবিজি প্রসঙ্গে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, “এটা কোন দেশে বাস করছি!”
সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটুর দশম রাজ্য সম্মেলন শেষে হাওড়ার ডুমুরজলা ময়দানের সমাবেশে বুদ্ধবাবুর বক্তব্য, এবিজি-র তিন আধিকারিককে যে ভাবে রাতের অন্ধকারে অপহরণ করা হল, যে ভাবে হুমকি দিয়ে সংস্থাটিকে হলদিয়া ছাড়তে বাধ্য করা হল, তাতে নতুন শিল্প আসা তো দূর, চালু শিল্পও আর রাজ্যে থাকবে না। দুবরাজপুরের প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “ওখানে একটা সংস্থা কৃষকদের জমির দাম দেয়নি। তাদের একটা মাটি কাটার যন্ত্র গ্রামবাসীরা আটকে রেখেছিলেন। এক মন্ত্রী নির্দেশ দিলেন, যন্ত্র উদ্ধার করতে হবে। গুলি চলল! এখন মন্ত্রী বলছেন, জানতাম না!” বুদ্ধবাবুর কটাক্ষ, “অস্বীকার করাটা স্বভাব করে ফেলেছে এরা!”
বুদ্ধবাবুর জমানায় জমি নিয়ে আন্দোলন করেই নিজের ভিত শক্ত করেছিলেন মমতা। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তাঁর সিদ্ধান্ত, বেসরকারি শিল্পের জন্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে না। সংস্থাকে তা সরাসরি কিনে নিতে হবে। |
হাওড়ার ডুমুরজলা ময়দানের সমাবেশে। —নিজস্ব চিত্র |
পশ্চিমবঙ্গে যে এই নীতি বাস্তবে সম্ভব নয়, বুদ্ধবাবু, নিরুপম সেনরা তা বহু বার বলেছেন। এ দিনও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “জমি দিতে না পারলে কারখানা হবে না। কী হবে তা হলে? কী করে ছেলেমেয়েদের চাকরি হবে?” আক্ষেপের সুরে বলেছেন, “এক বছরে এতটা খারাপ হবে, ভাবতে পারিনি! আমরা সরকার থেকে চলে আসার পরে রাজ্য শিল্পে এক পা-ও এগোতে পারেনি!” নিজেদের ভুল আরও এক বার মেনে নেওয়ার পাশাপাশি তাঁর প্রশ্ন, “আমাদের সরিয়ে মানুষ কাদের আনলেন? একটা সরকার চলছে, যাদের এত বেশি দম্ভ!”
বস্তুত, দুবরাজপুর এবং এবিজি বিতর্কের মধ্যে শনিবার চলচ্চিত্র উৎসবের মহা-উদ্বোধনের পরে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, এই সরকার কি আদৌ শিল্পের প্রতি মনোযোগী? প্রশ্ন উঠেছে, শিল্পপতিদের নিয়ে একটা বিজয়া সম্মেলন করেই কি দায়বদ্ধতা শেষ হয়ে যায় সরকারের? শিল্পমহল বরাবরই বলে এসেছে, সরকার জমির ব্যবস্থা না করলে সমস্যা কাটবে না। কিন্তু সরকারের অবস্থান, জমি শিল্পসংস্থাকেই কিনে নিতে হবে। ফলে বিভিন্ন জায়গায় জমি ঘিরে সমস্যা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে হইহই করে চলচ্চিত্র উৎসব করতে দেখে রাজনীতির কারবারিরা প্রশ্ন তুলেছেন, “সরকারের লক্ষ্য যদি হয় চলচ্চিত্র শিল্পীদের নিয়ে উৎসব, তা হলে রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট মোচন হবে কী করে?”
এই কথা বলে একই দিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আক্রমণ করেছেন বুদ্ধবাবু এবং রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য।
বুদ্ধবাবুর বক্তব্যকে প্রত্যাশিত ভাবেই গুরুত্ব দিতে নারাজ শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর পাল্টা বক্তব্য, “এই বছরের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২২টি শিল্প-সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে ১ লক্ষ ৯ হাজার কোটি টাকার। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় তিন লক্ষ। মাত্র ১৫ মাসে এই অগ্রগতি বুদ্ধবাবু, নিরপমবাবু কখনও ভাবতে পেরেছিলেন?” তাঁদের জমি-নীতি নিয়েও প্রশ্ন উড়িয়ে পার্থবাবুর সাফ কথা, “জমি দখল করতে গিয়েই তো ওঁদের হাত পুড়েছিল! আমাদের সরকার পুলিশ দিয়ে অনিচ্ছুকদের জমি কাড়তে যাবে না। জমি আমাদের আছে।” যদিও ল্যান্ড ব্যাঙ্কের সেই মূলত লম্বাটে এবং তেরাবেঁকা জমিতে আদৌ শিল্প করা সম্ভব কি না, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে শিল্পমহল।
এ দিনই তমলুকে প্রদীপ ভট্টাচার্য অভিযোগ করেছেন, এবিজি হলদিয়া ছেড়ে যাওয়ায় রাজ্যের শিল্প ভাবমূর্তি খারাপ হয়েছে। এবিজি-বিতাড়নের প্রতিবাদে ২০ নভেম্বর হলদিয়ার চিরঞ্জীবপুরে বন্দর সংলগ্ন এলাকাতেই সমাবেশ করবে কংগ্রেস। তারই প্রস্তুতি বৈঠকে বসেছিলেন প্রদীপবাবু ও মানস ভুঁইয়া। পরে প্রদীপবাবু বলেন, “শিল্পপতিদের নিয়ে বিজয়া সম্মিলনী হচ্ছে। কিন্তু এই সরকারের আমলে শিল্প হয়েছে কি? সরকারের লক্ষ্য যদি চলচ্চিত্র শিল্পীদের নিয়ে উৎসব ও শোভাবর্ধন হয়, তা হলে রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট মোচন কী করে হবে?” এবিজি যে ভাবে শ্রমিক ছাঁটাই করেছে, তা অন্যায় বলে মেনে নিয়েও মানসবাবুর বক্তব্য, “এ নিয়ে যে ভাবে রাজনীতি হয়েছে, তা শিল্পায়নের পক্ষে অনুকূল নয়।” বৈঠকে যোগ দেওয়া এবিজি’র কাজহারা শ্রমিকদের কথায়, “তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে যে ভাবে এবিজি’কে তাড়ানো হয়েছে, তার প্রতিবাদে প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের সাহায্য চেয়েছি।” এবিজি-র কাজহারা এই শ্রমিকদের মতো প্রতিবাদের পথ ছাড়ছে না দুবরাজপুরের লোবা গ্রামের কৃষিজমি রক্ষা কমিটিও। গত শুক্রবার পার্থবাবু তাদের যে আশ্বাস দিয়েছেন, তা কার্যকর করতে প্রাথমিক ভাবে ১০ দিনের সময়সীমা দিয়েছে কমিটি। তা যে দিন শেষ হচ্ছে, সেই ১৮ নভেম্বর লোবায় একটি সমাবেশ করে ভবিষ্যতের কর্মপদ্ধতি ঘোষণা করা হবে। এ দিন লোবায় যান বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। আজ, সোমবার যাওয়ার কথা কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সির। অর্থাৎ, রাজনীতির লোকেদের নজর আপাতত সরছে না লোবা থেকে। |