কালীপুজোয় ওঁদের দরজা-জানলা খোলা বারণ। বিশেষ করে সন্ধের পরে। সাহস করে রাতের বেলা যাঁরা দরজা খোলেন, তাঁদের অনেককেই শেষ পর্যন্ত ভর্তি করতে হয় হাসপাতালে। সাবিত্রী ঘোষাল, দেবব্রত সাধুখাঁ, কণাদ দত্তরা তাই কালীপুজো আসার আগেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কেউ বা চলে যান কোনও নিরিবিলি কোনও স্থানে। কালীপুজো কাটিয়ে ফেরেন নিজের শহরে।
না, শব্দ-দৈত্য নয়। কালীপুজোয় ধোঁয়াসুরই বন্দি করে রাখে কণাদ দত্তদের। কণাদবাবু ফুসফুসের রোগে ভুগছেন অনেক দিন ধরে। বাকি দু’জন হাঁপানির রোগী। কালীপুজোটা ওঁদের কাছে আনন্দের নয়। ভোগান্তির। ফুসফুসের রোগের চিকিৎসক এবং বক্ষ বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বাজির ধোঁয়ায় দূষিত হাওয়ায় সুস্থ মানুষের শ্বাসনালী এবং ফুসফুসের উপরে মারাত্মক চাপ পড়ে। যাঁরা এমনিতেই হাঁপানি এবং ফুসফুসের অন্য রোগে ভুগছেন তাঁদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। তার উপরে বছরের এই সময়টায় বাতাস বয় কম। ফলে দূষিত হাওয়া এক জায়গায় অনেক ক্ষণ থেকে যায়। তাতে বিপদ বাড়ে আরও।
বাজির ধোঁয়া যে ক্ষতিকর তা চিকিৎসক কেন, সাধারণ মানুষের সবার জানা। বসু বিজ্ঞান মন্দির ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ৬ বিজ্ঞানী-গবেষকরা জানাচ্ছেন, কালীপুজোর বাজি-পটকা বাতাসে ধাতব ও অধাতব কণার পরিমাণ কতটা বিপজ্জনক ভাবে বাড়িয়ে দেয়। তাঁরা আরও দেখিয়েছেন, কলকাতার চেয়ে এই দূষণ অনেক গুণ বেশি হয় হাওড়ায়।
বাতাসে ভেসে বেড়ানো ওই কণারাই শ্বাসযন্ত্রের পথ আটকে দেয়। ফুসফুসের বায়ুথলির মধ্যে ঢুকে তার অনেকটা জায়গা দখল করে নেয়। শারীরবিজ্ঞানীরা বলছেন, এর ফলে এক দিকে ফুসফুসের বায়ু ধারণ ক্ষমতা যেমন কমে, তেমনই ওই কণাগুলির সঙ্গে বায়ুথলির পর্দা এবং শ্বাসনালীর দেওয়ালের ক্রমাগত ঘর্ষণে সেগুলির ক্ষতি হয়। এর ফলে শ্বাসজনিত স্থায়ী রোগ পর্যন্ত হতে পারে বলে বক্ষ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন।
ভাসমান এই সব শ্বাসযোগ্য কণার ব্যাস ১ মিলিমিটারের ১০০ ভাগের এক ভাগ। এদের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা ভেবে ভারত সরকার বায়ুদূষণের সহ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বলা হয়েছে, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ওই রকম কণার সর্বোচ্চ পরিমাণ হতে পারে ১ মিলিগ্রামের দশ ভাগের এক ভাগ। সোজা কথায় ১০০ মাইক্রোগ্রাম। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়, চিরন্তন সরকার, আনন্দময় আদক, সঞ্জয় ঘোষ, শিবাজি রাহা এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়রা বিভিন্ন এলাকায় বছরভর বাতাসে বিভিন্ন পদার্থের পরিমাণ মেপেছেন। তাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, কালীপুজোর সময় বাতাসে এই সব দূষণকারীর মাত্রা কতটাই বিপজ্জনক আকার নেয়।
দেখা গিয়েছে, কালীপুজোর আগের, কালীপুজোর দিন এবং কালীপুজোর পরের দিন এই তিন রাতে বাতাসে ভাসমান বিপজ্জনক কণার পরিমাণ পৌঁছে যায় ৭১১ মাইক্রোগ্রামে। যা সহ্যমাত্রার চেয়ে সাত গুণেরও বেশি। অন্য দিনের তুলনায় কালীপুজোর সময় বাতাসে অ্যালুমিনিয়াম বা দস্তা বাড়ে ৫-৬ গুণ, সিসা, তামা, লোহা বা ক্যাডমিয়ামের মতো ধাতু বেড়ে যায় ১০ থেকে ২৫ গুণ। কোবাল্ট ৭০ গুণ। ভ্যানাডিয়াম ৮০ গুণ। এগুলির বেশির ভাগই বাতাসে থাকে কণা হিসেবে। ছয় বিজ্ঞাণী-গবেষকের ওই গবেষণা পত্রটি ‘এরোসল অ্যান্ড এয়ার কোয়ালিটি রিসার্চ’ জার্নালে প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়েছে।
ওই গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাজি-পটকায় যে কালো গুঁড়ো থাকে, তার মধ্যে মেশানো হয় কাঠকয়লা, সালফার, পটাশিয়াম নাইট্রেট। এদের অত্যধিক মাত্রা ফুসফুসের পক্ষে ক্ষতিকর। ক্যাডমিয়াম বা নিকেলের মতো ধাতু যে ক্যানসারের, ম্যাঙ্গানিজ যে স্নায়ুরোগের, তামা ও ভ্যানাডিয়াম যে শ্বাসরোগের জন্য দায়ী, তা তো প্রমাণিত সত্য। বাজি-পটকায় ওই সব পদার্থ যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা রংয়ের ধোঁয়া, আলোর ছটা কিংবা ফুলকি তৈরির জন্য।”
কলকাতার ওই দূষণের প্রভাব ছড়ায় কত দূর? অভিজিৎ ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা দাবি করেছেন, দূষণের যাত্রাপথ শেষ হয় ৯০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবন এলাকায়। যেখানকার পরিবেশের বিশুদ্ধতা বাঁচানো রীতিমতো জরুরি বলে দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা। শহর যতো ঘিঞ্জি হবে ততই দূষণের প্রভাব মানুষের উপরে বেশি করে পড়বে। বলে দাবি গবেষকদের। অন্য একদল বিজ্ঞানীর বায়ুদূষণ সমীক্ষার ফল তুলে ধরে অভিজিৎ বলেন, কলকাতার থেকে ওই সব ভাসমান কণার দূষণ হাওড়ায় অনেক বেশি।
অন্য সময়ের তুলনায় কালীপুজোর কলকাতায় বাতাসে ভাসমান শ্বাসযোগ্য কণা বেড়ে যায় অন্তত ৫ গুণ। হাওড়ায় তা বাড়ে ৭ গুণেরও বেশি। সিসা কলকাতায় বাড়ে ১১ গুণ, হাওড়ায় ১৫ গুণ। ক্যাডমিয়াম কলকাতায় ১২ গুণ, হাওড়ায় ১৭ গুণ। তামা কলকাতায় ২৫ গুণ, হাওড়ায় ৭৯ গুণ।
বাজির দূষণের শারীরিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বক্ষরোগ চিকিৎসক আলোকগোপাল ঘোষাল জানান, দীপাবলির বাজির ক্ষতি সুদূরপ্রসারী। বিশেষত শিশু এবং বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, “শীতে বায়ু চলাচলের গতি কমে যায়। তাই দূষিত ধোঁয়া এক জায়গায় অনেক ক্ষণ বদ্ধ হয়ে থাকে। হাউজিং কমপ্লেক্সগুলিতে এক জায়গায় অনেকটা সময় ধরে আলোর বাজি পোড়ানো হয়, তার ক্ষতিও যথেষ্ট। সেখানকার বাসিন্দাদের শারীরিক ক্ষতিও তাই তুলনায় বেশি।”
পালমোনোলজিস্ট পার্থসারথি ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, বাজি তৈরির বেশির ভাগ উপকরণই ক্ষতিকর। তাই কালীপুজো, দীপাবলির পরে রোগীর সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যায়। হাঁপানি বা সিওপিডি-র রোগীদের অনেককে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয়।
বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তা শিবাজি রাহা বলেন, “আমাদের গবেষণায় দূষণের মাত্রা ও তার উৎসটা ধরা পড়েছে। এখন জরুরি সমস্যা মেটাতে পদক্ষেপ। বাজি-পটকায় কী থাকবে, কী থাকবে না তা ঠিক করা।”
|