মাঝরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল সাম্যর। এমনিতে ওর ঘুম খুব গাঢ়। দিদি তো ওকে খেপায় যে, কানের কাছে কাড়ানাকাড়া বাজালেও নাকি ওর ঘুম ভাঙবে না! সে দিন রাতে কাড়ানাকাড়া অবশ্য বাজেনি, কিন্তু সাম্যর মনে হচ্ছিল ওর গায়ে ঠান্ডা জলের মতন কী একটা ঢেলে দিচ্ছিল কেউ! ‘আরে কী হচ্ছে এ সব?’ বলে উঠে বসল সাম্য।
প্রথমে সে ভেবেছিল এটা বোধ হয় দিদির কাজ, কিন্তু তার পর মনে পড়ল দিদি তো আজ সকালেই মা-র সঙ্গে পটনা গিয়েছে। বড়মামুর শরীর খারাপ তাই ওঁকে দেখতে। তিন দিন পরে ফিরবে। তা হলে এত রাতে কে? ঘরে নাইট ল্যাম্পটা জ্বলছে। সেই আবছা আলোতে সাম্য দেখল ওর ঘরে দুটো হাঁস ঢুকেছে! তাদের এক জনের মুখে একটা খেলনা প্লাস্টিকের বালতি! ভীষণ চমকে উঠল সাম্য। হাঁস দুটো ঘরে ঢুকল কী করে? ওরাই কি ওর গায়ে জল ঢালল?
গায়ে হাত দিয়ে মুখ বেঁকাল সাম্য, না জল নয়, চ্যাটচ্যাটে একটা পিচ বা আলকাতরা জাতীয় কিছু! কোথা থেকে এনেছে ওরা দু’জনে, কে জানে।
বেশ রাগী রাগী মুখ করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল হাঁস দুটো। এ বার ওর গায়ে চ্যাটচ্যাটে পিচ পড়েছে বলে ওর অস্বস্তি দেখে ওদের মুখে হাসি ফুটল। ‘কেন করলে তোমরা এই রকম?’ সাম্য বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল। ‘হুঁ, সে দিন সজলদিঘির ধারে পিকনিক করে ফেরার সময় তুমি কী করেছিলে, মনে আছে কি?’ হাঁসেদের মধ্যে এক জন বলল।
গায়ে পিচ পড়াতে সাম্য এতটাই বিচলিত ছিল যে হাঁসকে কথা বলতে শুনে আশ্চর্য হতেও ভুলে গেল। পাড়া থেকে ওরা কয়েকটা পরিবার সজলদিঘির ধারে চড়ুইভাতি করতে গিয়েছিল। ওখানেই রান্না করে খাওয়াদাওয়া হয়েছিল। ভারী মজা হয়েছিল। ‘কেন খাওয়াদাওয়া আর মজা করেছি, আর কী করব?’ ‘না, সে সব কথা বলছি না! ফিরে আসার ঠিক আগে তুমি কী করেছিলে?’
সাম্যর হঠাৎ মনে পড়ে গেল! কেরোসিন তেলের একটা শিশি গিয়েছিল। সেটা ব্যবহার হয়নি। সব শেষে যখন বাসনপত্র ইত্যাদি তোলা হচ্ছে মা ওকে শিশিটা দিয়ে বলেছিলেন, ‘যাও সাম্য এই বোতলটাকে সাবধানে বাসে রেখে এসো।’
সাম্য কিন্তু মার কথা পুরোপুরি শোনেনি। বোতলটা বাসে নিয়ে গিয়ে রাখার আগে তেলটা হুড়হুড় করে দিঘির জলে ঢেলে দিয়েছিল, ‘হোলি হ্যায় হোলি হ্যায়’ করে চেঁচাতে চেঁচাতে! |
এখন সে ফিসফিস করে বলল, ‘তেল?’
‘হ্যাঁ, তেল! তোমার ঢালা ওই তেল আমাদের ছোট্ট সোনার ডানায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছে আর বেচারা এখন উড়তে পারছে না। আমরা তাই তোমাকে বোঝাতে চাইছিলাম গায়ে ওই রকম কিছু পড়লে কী রকম লাগে! তুমি যেটা ফেলেছিলে সেটা খুঁজে পাইনি, যা পেয়েছি তাই এনেছি!’
এখন কী করবে সাম্য? মা বাবাকে কী করে বোঝাবে চাদরে পিচ লাগল কী করে? ওরা তো কখনওই বিশ্বাস করবেন না যে ও কিছু করেনি, দুটো হাঁস এসে ওর গায়ে পিচ ঢেলে দিয়ে গিয়েছে।
‘এ বার তুমি ওই ভাবেই ঘুমোও!’ বলে হাঁসগুলো গুটিগুটি পায়ে হেঁটে ওর শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কী আশ্চর্য! এই চিটচিটে পিচ নিয়েও ঘুমিয়ে পড়ল সাম্য। ঘুমটা যখন আবার ভাঙল তখন ওর অবস্থা আরও শোচনীয়! অনেকগুলো ব্যাঙ চার পাশ থেকে ওকে ধরেছে আর কয়েকটা ব্যাঙ ওর মুখটা হাঁ করিয়ে তাতে একটা প্লাস্টিকের বোতলের ছিপি গুঁজে দিচ্ছে!’
কাশতে কাশতে কোনও রকম ‘থু থু’ করে ছিপিটাকে মুখ থেকে বার করল সাম্য, ‘কী করছ তোমরা! মুখে ছিপি ঢুকিয়ে দিচ্ছিলে কেন? ওটা গলায় আটকে গেলে মুশকিল হয়ে যেত!’
ওদের মধ্যে থেকে বড়সড় একটা ব্যাঙ বলল, ‘কী হয় সেটা যাতে তুমি হাড়ে হাড়ে টের পাও, সেই জন্যই তো আমরা এসেছি! বেচারা সবুজের কেমন লেগেছিল সেটা তোমার বোঝা উচিত!’
‘সবুজ? সবুজ আবার কে?’
‘সবুজ আমাদের বন্ধু ছিল। সে দিন তোমরা সবাই সজলদিঘির ধারে পিকনিক করলে আর জল খেয়ে প্লাস্টিকের বোতলগুলো জলে ছুড়ে ফেলে দিলে। তারই একটার ছিপি খুলে গিয়েছিল। বেচারা সবুজ ওটাকে পোকা ভেবে খেয়ে ফেলল। ব্যস ছিপিটা ওর গলায় আটকে...’ আর বলতে পারল না ব্যাঙটা।
সাম্য আর কী করবে! সব শুনে বলল,
‘ও, তোমাদের বন্ধুর মৃত্যুর ব্যাপারটায় আমি খুব দুঃখিত!’
ওর কথা শুনে খুশি না হয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল ব্যাঙটা!
‘ওই সব মিষ্টি কথায় কিছু হবে না! প্রথমে সবুজকে মেরে এখন দুঃখিত হওয়ার অভিনয় করা হচ্ছে! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা!’
সাম্য হাঁউমাঁউ করে বলল, ‘না, না, অভিনয় নয়! আমি সত্যিই দুঃখিত।’
‘সত্যি যদি দুঃখিত হতে তা হলে ছিপিটা ‘থু’ করে মুখ থেকে বার না করে ওটাকে গিলতে চেষ্টা করে দেখতে! অবশ্য কী আর বলব তোমরা মানুষেরা আমাদের কথা একদম ভাব না। তুমি তো নেহাতই বাচ্চা, বড়রাই ভাবে না তো তুমি আর কী করবে। আজকে সবুজের যা হয়েছে কালকে অন্য কোনও জায়গায় অন্য কোনও বন্ধুর হবে আর শেষে এক দিন আমাদেরও হবে আর তোমরা দিব্যি চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোবে। চলো বন্ধুগণ, এ বার আমরা যাই। অন্যরা অপেক্ষা করছে।’
সাম্য বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘মানে? অন্য আবার কারা?’
ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই খপাত করে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ এসে পড়ল ওর মুখের ওপর। সুড়ুৎ করে ওর মাথাটাকে ব্যাগের মধ্যে গলিয়ে ফেলল অনেকগুলো মাছ!
সাম্য শুনতে পেল ওদের এক জন বলছে, ‘এই যে সাম্য! খুব মজা করলে চড়ুইভাতিতে, তাই তো? তা মজা করছ করো কিন্তু এই সব প্লাস্টিকের ব্যাগ আর আবর্জনা আমাদের জন্যে ফেলে যাওয়া কেন বাবা? বেচারা বিলু আর হারুর ওই সব খেয়ে সে কী পেট খারাপ! ওরা তো তাও মরে যায়নি, কিন্তু আমি আমার দাদুর কাছে শুনেছি, সমুদ্রেও নাকি তোমরা এই সব প্লাস্টিক ফেলে দিচ্ছ! বেচারা কচ্ছপগুলো এগুলোকে জেলিফিশ ভেবে খেয়ে মরে যায়। কত শত সামুদ্রিক প্রাণীর ক্ষতি করে এগুলো তার হিসেব নেই। তা হলে তুমিই বলো আমাদের কেমন লাগে?’
প্লাস্টিকের প্যাকেটটা আরও যেন চেপে বসেছে মুখের চার পাশে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। দম যেন আটকে আসছে!
‘আঁ আঁ’ করে চিৎকার করে উঠল সাম্য। হাত-পা ছুড়ে ‘ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও’ করে চেঁচাতে লাগল।
ঠিক ওই অবস্থায় ঘুমটা ভেঙে গেল ওর! গায়ের চাদরটা গলায়-মাথায় পেঁচিয়ে ফেলেছিল সে তাই ওই রকম লাগছিল! ঘেমে সপসপে ভিজে গিয়েছে বিছানার চাদর!
পেঁচানো চাদরটাকে সরিয়ে বিছানা
থেকে নেমে আলো জ্বালিয়ে বোতল থেকে দু’ঢোঁক জল খেল সাম্য। না সত্যি ওদের খুব ভুল হয়ে গিয়েছে, সেটার একটা প্রতিকার করতেই হবে!
কী করা যায় ভেবে না পেয়ে পর দিন বিজ্ঞানের শিক্ষককে কথাটা বলল সাম্য।
দু’দিন বাদেই বিজ্ঞানের প্রোজেক্ট হিসাবে ওদের ক্লাসের সবাইকে সজলদিঘির ধারে নিয়ে গেলেন ওদের শিক্ষক। সেখানে ওরা পাড় থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করল। লম্বা লাঠি দিয়ে টেনে ভাসমান প্লাস্টিকের প্যাকেট আর বোতলগুলোকে সরাল আর নিজেদের হাতে তৈরি ব্যানারগুলো দিঘির চার ধারে লাগিয়ে দিল
‘এখানে প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ ইত্যাদি আবর্জনা ফেলা নিষেধ!’ অথবা ‘সজলদিঘিকে পরিষ্কার রাখুন!’
ওরা যখন স্কুলে ফিরে যাওয়ার জন্যে বাসে উঠছে তখন সাম্য দেখল একটু দূরে একটা হাঁস দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার পাশে একটা ছোট্ট হাঁস ছানা। ওকে দেখে মা-হাঁসটা দু’বার ডানা ঝাপটাল তার পর বাচ্চাটাকে নিয়ে হেলতে দুলতে গিয়ে দিঘির জলে নেমে পড়ল। একটা অদ্ভুত শান্তিতে ভরে গেল সাম্যর বুক!
|