খনির জন্য ন্যায্য ক্ষতিপূরণের দাবি, মাটি তপ্ত বড়জোড়াতেও
নি ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভএই নিরিখে প্রায় দুবরাজপুরের লোবার মতোই জমি তেতে রয়েছে বাঁকুড়ার বড়জোড়ায়। ট্রান্স-দামোদর কোলিয়ারি এলাকায় ওই আন্দোলনের রাশ কোনও রাজনৈতিক দলের হাতে নেই। ১৪টি গ্রামের বাসিন্দারা তিনটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে দাবিদাওয়া জানাচ্ছেন প্রশাসন এবং খনি কর্তৃপক্ষের কাছে।
ঘটনাচক্রে বড়জোড়ার এই এলাকা যে কতটা তপ্ত তার ইঙ্গিত মিলেছিল সেই মঙ্গলবার, যে দিন পুলিশ-জনতা সংঘর্ষে তেতে উঠেছিল লোবা। ওই দিন এলাকা পরিদর্শনে যাওয়া বিধানসভার খনি বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কাছে নানা অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। লোবার সঙ্গে ফারাক বলতে বড়জোড়ায় খনি থেকে কয়লা তোলা শুরু হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, সেই খনির জন্য তাঁদের জমি-বাড়ি গিয়েছে। কিন্তু পুনর্বাসন মেলেনি। কারও ক্ষোভ, খনির কাদা-জল জমি গ্রাস করেছে। কারও দাবি, খনির কাজ শুরু হওয়াতে জলস্তর নেমে গিয়েছে। পানীয় জল ঠিকমতো মিলছে না। গত ১৩ এপ্রিল খোলামুখ খনির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয় আটকে এমনই সব ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন এলাকাবাসী। মুখ্যমন্ত্রী জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি দেখতে বলেন। কিন্তু স্থানীয়দের ক্ষোভ, “তার পরেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি।” মঙ্গলবার স্থায়ী কমিটিকে ফের সেই সব অভিযোগ জানাতে যাওয়া ক্ষুব্ধ জনতাকে পুলিশ লাঠি চালিয়ে সরিয়ে দেয় বলে অভিযোগ। গ্রেফতার তিন।
বাড়ির ফাটল দেখাচ্ছেন এক গ্রামবাসী। জমাদার গ্রামে। —নিজস্ব চিত্র
রাজ্য সরকারের ‘ওয়েস্টবেঙ্গল মিনারেল ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড’ ২০০৬ সালে বড়জোড়ার ৯টি মৌজার ৬৯৪ একর জায়গায় খোলামুখ খনি গড়ার পরিকল্পনা নেয়। ‘ট্রান্স-দামোদর কোল মাইনিং প্রজেক্ট’ নামে সরকার ও বেসরকারি যৌথ অংশীদারির ওই প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা প্রশাসনকে। ধাপে ধাপে এ পর্যন্ত ২৮২ একর জমি অধিগৃহীত হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে ধরা হয়েছিল, ওই এলাকায় মাটির নীচে প্রায় ৪৮ মিলিয়ন টন উৎকৃষ্ট কয়লা রয়েছে। প্রায় এক বছর আগে সেই কয়লা তোলাও শুরু হয়।
অধিগ্রহণের প্রাথমিক পর্বে ডাঙা জমি প্রতি একর ১১ লক্ষ টাকা, জলা জমি একর প্রতি ৯ লক্ষ টাকা, বাড়ি-সহ বাস্তু জমি নিলে বাড়ির জন্য আলাদা করে ৩ কাঠা জমির উপরে ৫৫০ বর্গফুটের বাড়ি করে দেওয়া, ৬ বিঘার বেশি জমি দিলে পরিবারের এক জনকে খনিতে চাকরি দেওয়ার শর্তের মতো বিষয় ছিল ক্ষতিপূরণের প্যাকেজে। স্থানীয় সূত্রে খবর, সমস্যার শুরু অধিগৃহীত জমিতে ২০০৮-এ খনি তৈরির কাজ শুরু হতেই। খনি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পুনর্বাসন না দেওয়া, খনির জন্য বাড়ি-চাষের জমির ক্ষতি হওয়া, জলস্তর নেমে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। ২০০৮ থেকে ‘ন্যায্য’ ক্ষতিপূরণের দাবিতে আন্দোলনে নামেন স্থানীয় বাসিন্দারা। জমিহারাদের নিয়ে তৈরি ‘ভালিতাবুড়ি ল্যান্ডলুজার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’, ‘ধর্মরাজ ভূমিহারা বাস্তুহারা সমিতি’ এবং ‘জমাদার গ্রাম ষোলোআনা কমিটি’র সদস্যদের বক্তব্য, “জমি দেওয়ায় আমাদের আপত্তি নেই। তবে খনি কর্তৃপক্ষকে বর্ধিত দাম দিয়ে জমি নিতে হবে।”
এক সময় আন্দোলনকারীদের সামনের সারিতে ছিলেন বড়জোড়া পঞ্চায়েতের বর্তমান প্রধান তথা এলাকার তৃণমূল নেতা অলক মুখোপাধ্যায়। প্রশাসনে এসে জন প্রতিনিধি হিসেবে তিনি এই সমস্যা মেটাতে সক্রিয় ভূমিকা নিলেন না কেন? অলকবাবু বলেন, “ভূমিহারা মানুষ এখন নিজেরাই সংগঠন করে আন্দোলন করছেন। তাই আমরা এখন মাথা ঘামাই না।” তবে বড়জোড়া পঞ্চায়েতের প্রাক্তন তৃণমূল প্রধান টিঙ্কু মণ্ডল এখন ‘ভালিতাবুড়ি ল্যান্ডলুজার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভানেত্রী। বড়জোড়া পঞ্চায়েতের বর্তমান তৃণমূল সদস্য কার্তিক ভুঁই ‘জমাদার গ্রাম ষোলোআনা কমিটি’রও নেতা। টিঙ্কুদেবী ও কার্তিকবাবুর বক্তব্য, “এ ব্যাপারে দলের কী দৃষ্টিভঙ্গি জানি না।
অভিযোগ
চুনপাড়া, ভিড়কাশোল এবং জমাদার গ্রামের (আংশিক) বাসিন্দাদের বাড়ি অধিগ্রহণ হলেও পুনর্বাসন দেওয়া হয়নি।
খনির জন্য মাটিতে যে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, তাতে বহু বাড়ির কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে।
জলস্তর নেমে গিয়ে পানীয় জলের সঙ্কট দেখা গিয়েছে।
খনির জন্য তোলা মাটি ও জলে চাষের জমি নষ্ট হয়েছে।
প্রস্তাবিত খনি এলাকায় আমাদেরও জমি আছে। তা এখনও অধিগ্রহণ হয়নি। অথচ, খনিটা তৈরি হওয়ার সময় এলাকায় না নেওয়া বহু একর জমি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু খনি কর্তৃপক্ষ জমির দাম বাড়াতে চাইছেন না। পুনর্বাসনও দিচ্ছেন না। তাই আন্দোলন শুরু করেছি।” এই খনির জন্য জমিহারাদের ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ যখন তৈরি হয়, তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্রের। তিনি এখন বলছেন, “ভেবেছিলাম, রাজ্য সরকার ও খনি কর্তৃপক্ষ গ্রামবাসীদের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মেটাবেন। কিন্তু এখন দেখছি, তা হচ্ছে না। বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রুত আমরা আন্দোলনে নামব।”
তবে জমিহারাদের সংগঠনগুলির অভিযোগ মানতে চাননি ট্রান্স-দামোদর কোলিয়ারির ম্যানেজার আর কে সিংহ। তাঁর দাবি, “যাঁদের চাষ জমিতে ক্ষতি হয়েছে তাঁদের প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। এলাকায় পানীয় জলেরও ব্যবস্থা করেছি আমরা। পুনর্বাসনের কাজও শুরু হওয়ার মুখে।” বড়জোড়ার তৃণমূল বিধায়ক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “জমিদাতাদের পুনর্বাসন দেওয়ার কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। যাঁদের জমির ক্ষতি হয়েছে, তাঁদের ক্ষতিপূরণও দেওয়া হচ্ছে।” তাঁর আশ্বাস, “পুরো বিষয়টির উপর রাজ্য সরকারের নজর রয়েছে।”
জমিহারাদের সব ক’টি সংগঠনেরই ক্ষোভ, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দেওয়ার পরেও জেলাশাসক থেকে বিডিও কেউই আমাদের আলোচনায় ডাকেননি। প্রশাসনের কোনও আধিকারিক আমাদের সমস্যার কথা জানতে আসেননি।” জেলাশাসক বিজয় ভারতী বলেন, “আমি মাসখানেক আগে দায়িত্ব পেয়েছি। খনি কর্তৃপক্ষ ও গ্রামবাসীদের নিয়ে শীঘ্রই আলোচনায় বসব। সমস্যা মেটাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে আন্দোলনকারীরা সমস্বরে বলছেন, “এত দিন আমাদের কথা কেউ শোনেনি। লোবার ঘটনার পরে যদি টনক নড়ে!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.