অসন্তোষ সরিয়ে সংস্কারের প্রচারেই দলকে চান সনিয়া
সুরজকুণ্ডের সম্মেলনে জনমোহিনী রাজনীতির পথে ফেরার দাবি উঠলেও আর্থিক সংস্কারকে হাতিয়ার করে ভোটযুদ্ধে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সনিয়া গাঁধী-মনমোহন সিংহ। তাই দলের যে নেতা-মন্ত্রীরা রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রে ভর্তুকির সিলিন্ডার বাড়ানো বা জনমুখী বাজেটের দাবি তুলেছেন, তাঁদের প্রতি কংগ্রেস সভানেত্রীর বার্তা, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সকলকেই বুঝতে হবে। এই নিয়ে দল ও সরকারের মধ্যে ভিন্ন রণকৌশল নেওয়া চলবে না। আমজনতাকে সংস্কারের গুরুত্ব বোঝানোর দায়িত্বও তিনি দলকে নিতে বলেছেন। সরকারের তরফেও প্রচার চালাতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন তথ্যমন্ত্রী মণীশ তিওয়ারিকে।
কী বোঝাবেন মণীশ তিওয়ারি, বা দল? কংগ্রেস সূত্রের খবর, বহু ব্র্যান্ডের খুচরো পণ্য থেকে বিমা-পেনশনে বিদেশি লগ্নি এ সবই যে ভারতের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের স্বার্থে, সেটাই প্রচার করবেন তাঁরা।
আসলে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি না সংস্কারের কঠিন পথে পা, এই দোলাচল কংগ্রেসের মধ্যে আজ নতুন কিছু নয়। অনেকে বলেন, সংস্কার-বিরোধী অসন্তোষটা কংগ্রেসের ডিএনএ-র মধ্যে ঢুকে রয়েছে। আর শুধু কংগ্রেসই বা কেন, আর্থিক সংস্কার ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে কম-বেশি বিতর্ক ভারতের সব দলের মধ্যেই আছে। যেমন, জ্যোতি বসু অথবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্পায়নের কথা বললেও আলিমুদ্দিন ও সিটু শিল্প ধর্মঘটের পথে হাঁটে। বিজেপি জমানাতেও সরকারের প্রশাসনিক বাধ্যবাধকতার সঙ্গে দল তথা আরএসএসের সংঘাত ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছিল। ইউপিএ-২ জমানাতেও শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শরিকই নন, মনমোহন সিংহের সরকারের সঙ্গে সনিয়া গাঁধীর নেতৃত্বাধীন দলের মতপার্থক্য নানা বিষয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে। মনমোহন আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ও সংস্কারের কথা বললেও সনিয়ার দল পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদ জানিয়েছে। সরকার যে জমি-নীতির প্রস্তাব করেছে, সনিয়া তা বদলাতে বাধ্য করেছেন। এআইসিসি-র আর্থিক প্রস্তাবগুলিতেও সামাজিক দায়বদ্ধতা সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। নেহরুবাদী সমাজতান্ত্রিকতা বার বার মেনে চলতে চেয়েছে কংগ্রেস। কারণ দলের বহু প্রবীণ নেতাই একাধিক বার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আর্থিক সংস্কারের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে ভোটবাক্সে।
এই আশঙ্কাও নতুন নয়। এই টানাপোড়েন চলে আসছে স্বাধীনতার সময় থেকেই। যেমন, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী বলেছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতির কথা। আর প্রধানমন্ত্রী হয়ে নেহরু তার বিপরীতে হেঁটে রুশ মডেল অনুকরণে ভারী শিল্পায়নের দিকে গেলেন। সেটা ছিল সময়ের দাবি। আবার ’৬৯ সালে সময়ের দাবিতেই ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করলেন ইন্দিরা গাঁধী। সংবিধানে জুড়ে দিলেন সমাজতন্ত্র শব্দটি। কিন্তু সেই সংযুক্তির রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা আজ কতখানি, তা নিয়ে এখনও দলের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
ইন্দিরার আমল পেরিয়ে রাজীবের সময় থেকেই মোড় ঘুরতে শুরু করে ধীরে ধীরে। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা বলেন, রাজীব গাঁধী যখন স্যাম পিত্রোদাকে সামনে রেখে টেলিকম বিপ্লব করেন, তখন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পর্যন্ত ‘গেল গেল’ রব উঠেছিল। অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, এসটিডি-আইএসডি বুথ গ্রামের মানুষ ভাল ভাবে নেবে না। কিন্তু রাজীব বলেছিলেন, “আমি জানি, আমি যা করছি, মানুষের ভালর জন্যই। তা হলে মানুষ আমাকে ভুল বুঝবে কেন?” পিভি-র জমানায় যখন অন্ধ্রপ্রদেশের ভোটে দু’টাকা কিলোগ্রামে চাল দেওয়ার স্লোগান তুলে এন টি রাম রাও মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেলেন আর কেন্দ্রীয় সংস্কার হাঁটতে লাগল সংস্কারের কঠিন পথে, আবারও ‘হায় হায়’ উঠল ওয়ার্কিং কমিটিতে।
সেই ভূত আজও কংগ্রেসের পিছু ছাড়েনি। সংস্কারের বিরোধিতা করছেন যাঁরা, তাঁদের যুক্তি, ওই সব সংস্কারের পরে কিন্তু কংগ্রেস হেরেছিল। কিন্তু সনিয়া এ বার অন্য ভাবে ভাবছেন। তাঁর বক্তব্য, প্রতি বারেই কংগ্রেস হেরেছে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায়। এ বার বরং তেমন অভিযোগের মোকাবিলায় সংস্কারকে হাতিয়ার করে এগোনো সম্ভব। তাই সনিয়া চাইছেন, ভয় না পেয়ে দল যেন সংস্কারের উপকারিতা সম্পর্কে প্রচার শুরু করে দেয়। যেন মানুষকে বোঝায়, এর ফলে ক্ষতির চেয়ে লাভই হবে বেশি।
ইউপিএ-১ জমানায় মনমোহন যখন আন্তর্জাতিক প্রযুক্তিগত সখ্যের উপরে জোর দিয়েছিলেন, তখনও সনিয়া ছিলেন তাঁর পাশে। তাই একশো দিনের কাজের মতো সামাজিক প্রকল্পের পাশাপাশি কংগ্রেস প্রচারে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির কথাও হাতিয়ার করেছিল। তখনও দলের একাংশ আশঙ্কা করেছিল, এই চুক্তির ফলে দল সংখ্যালঘু ভোট হারাবে। বিপুল মধ্যবিত্ত ভোটব্যাঙ্কও বিরূপ হবে। কিন্তু আখেরে, ভোটবাক্সে সুফলই পেয়েছে কংগ্রেস।
ইউপিএ-২ জমানায় দ্বিতীয় দফার সংস্কারের পরে কাল সুরজকুণ্ডের সাংবাদিক বৈঠকে কমল নাথ, দিগ্বিজয় সিংহদের কণ্ঠে যে সংস্কার-বিরোধী ‘গেল গেল’ রব শোনা গিয়েছে, তা দলের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবন্ধকতারই পরিচায়ক। তবে আলোচনাপর্বেই সনিয়া দলের সুর বেঁধে দিয়েছেন। তা হল সংস্কার নিয়ে প্রচার। তাই সমন্বয় কমিটি তৈরির কথা হয়েছে। সনিয়া বুঝিয়ে দিয়েছেন, দল-সরকারের মধ্যে যে স্ববিরোধ, তা থেকে বেরনো ও দৃঢ় সংকল্পে পৌঁছনোই তাঁর লক্ষ্য।
কংগ্রেস বলছে, সুরজকুণ্ডে সেই লক্ষ্যে অনেকটাই সফল সনিয়া-মনমোহন। বাকিটা বলবে ভবিষ্যৎ।

পাঁচ কাহন
• ১৯৮৪-’৮৯ কম্পিউটার, টেলিকম সংস্কার রাজীবের
• ১৯৯১-’৯৬ পিভি-র জমানায় সংস্কারের প্রথম ঢেউ
• ২০০৪ ‘মানবিক মুখ নিয়ে সংস্কার’-এর স্লোগান ইউপিএ-র
• ২০০৯ পরমাণু চুক্তি, একশো দিনের কাজে ভোটে সাফল্য
• ২০১২ ভর্তুকি ছাঁটাই, আরও খুলল বিদেশি লগ্নির দরজা


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.