তিনি গুজরাতের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে কিন্তু পুরোদস্তুর বাঙালির জামাইবাবু!
শনিবার যে অমিতাভ বচ্চনকে দেখল কলকাতা, তিনি কার্যত কলকাতা তথা বাংলার শুভেচ্ছা দূতের ভূমিকাই পালন করে গেলেন!
গত বারই নন্দন চত্বর ছাড়িয়ে চলচ্চিত্র উৎসবকে জনমুখী করে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরই আমন্ত্রণে উৎসব উদ্বোধনে এসেছিলেন শাহরুখ খান। তার পরই তাঁকে বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হওয়ার প্রস্তাব দেন মমতা। শাহরুখ রাজি হয়ে যান। এ বারের উৎসবে মমতার সরকারের বয়স আরও এক বছর বেড়েছে। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, জুনিয়র ডনকে পাশে নিয়েই এ বার মমতার আমন্ত্রণ গিয়েছে সিনিয়র ডন অমিতাভ বচ্চনের কাছে। অমিতাভ শুধু এলেনই না। অননুকরণীয় বাচনে বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির উদ্যাপনকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেলেন, রাজ্যের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তা মোক্ষম বিজ্ঞাপন হয়ে উঠতে পারে। এ দিনের পরে বিভিন্ন মহল থেকেই বলা হচ্ছে হলদিয়া-কাণ্ডের রেশ পিছনে ফেলে নতুন করে শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি গড়ে তোলার যে প্রয়াস চালাচ্ছেন মমতা, সেখানে অমিতাভ যেন নিজে থেকেই অনেকটা সাহায্য করে গেলেন তাঁকে।
এ দিনই সর্বসমক্ষে দেখানো হল শাহরুখ অভিনীত এ রাজ্যের বিজ্ঞাপনী-চিত্র। যেখানে শাহরুখ বলছেন, বাংলার নিজস্বতার কথা। “দেয়ার ইজ সামথিং স্পেশ্যাল অ্যাবাউট বেঙ্গল।” কী সেই বিশেষত্ব? ব্যাখ্যাটা কিন্তু করে গেলেন অমিতাভ। বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত বাংলার মাটি বাংলার জল, এ দিন উচ্চারিত হল অমিতাভেরই কণ্ঠে। নিজের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে শাহরুখ বলেছিলেন কলকাতার আতিথেয়তার কথা, বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির কথা, বাংলার প্যাশনের কথা। সেই সব কিছুর বর্ণনাকারের ভূমিকাটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন অমিতাভ। মিঠুন বলছিলেন, “কলকাতা ইজ দ্য বেস্ট!” অমিতাভর কথায় প্রাঞ্জল হল সেই শ্রেষ্ঠত্বের স্বরূপ।
শুরু করলেন বাংলায়। এক নিমেষে কলকাতার তামাম দাদা-দিদি-মামা-মামিকে একেবারে আপন করে নেওয়া জামাইবাবু। তার পর চলে গেলেন ইংরেজিতে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের শতবর্ষের প্রাক্কালে অমিতাভর কথায় জ্যান্ত হয়ে উঠতে থাকলেন ফালকে, লুমিয়ের, হীরালাল সেন, জে এফ ম্যাডান..। রাজা হরিশচন্দ্র থেকে আলম আরা হয়ে জামাইষষ্ঠী..। বাংলার দেব-কোয়েলরা প্রত্যেকে পরে বলছেন, “কী অসাধারণ হোমওয়র্ক! ভাবা যায় না!” |
বাস্তবিকই অমিতাভ এ দিন যত খুঁটিনাটি তথ্য বলে যাচ্ছিলেন, তার অনেক কিছুই উইকিপিডিয়ায় খুঁজে মিলবে না।
বি এন সরকার, কানন বালা, প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকী বসু থেকে শুরু করে ছবি বিশ্বাস, ছায়া দেবী, চন্দ্রাবতী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ...। এলেন সত্যজিৎ-ঋত্বিক। মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা না গেলেও অমিতাভ বলতে ভুললেন না মৃণাল সেন আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা। উত্তমকুমারকে বর্ণনা করলেন ‘আসল (অরিজিনাল) গুরু’ বলে। অতীত আর বর্তমানের মধ্যে সেতুবন্ধনটা অবলীলায় ঘটে গেল। ছকে বাঁধা অতীত-তর্পণ নয়। অমিতাভের কথা থেকে এ দিন বেরিয়ে আসছিল ভারতীয় সিনেমার মানচিত্রে বাংলা সিনেমার অবস্থানের কথা। প্রমথেশ থেকে শাহরুখ, ‘দেবদাস’-ই প্রমাণ করে দিল, “স্মরণীয়তম সব চিত্রনাট্যের সুফলা জমি, বাংলা সাহিত্য।”
বাংলার বিপণন, ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ কলকাতার বিপণন। সত্তর পেরোনো অমিতাভ বচ্চন। ১৮তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী আসরে কলকাতার কাছে তাঁর যুবক বয়সের ঋণ স্বীকার করে গেলেন। “এই শহরে আমার জীবনের প্রথম চাকরি। আর এখানেই আমার অভিনয় করার ইচ্ছের বীজ বপন।” কয়েক বছর আগে বলা একটা কথার পুনরাবৃত্তি করে সর্বসমক্ষে বললেন, “কলকাতা জানে কী ভাবে ঝিমিয়ে-পড়া মনটাকে ভালবেসে চাঙ্গা করে তুলতে হয়। এত ভালবাসা দুনিয়ার কোথাও পাইনি।”
সত্যিই বেশ অনেক কাল পরে অমিতাভকে সামনে পেল কলকাতাও। ২০০৮-এ ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওয় ‘লাস্ট লিয়র’ ছবির শু্যটিংয়ে তাঁকে দেখতে ভেঙে পড়েছিল প্রিন্স আনওয়ার শাহ রোড। তার পরে বছরখানেক আগে প্রকাশ ঝা-র ‘আরক্ষণ’ ছবির প্রচারে এসেছিলেন। কিন্তু হোটেলের বাইরে বেরোননি। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন তিন দশক আগের স্মৃতি। ‘ইয়ারানা’ ছবিতে এই নেতাজি ইন্ডোরই ছিল অমিতাভের দু’টি গানের দৃশ্যের লোকেশন। রাতে অমিতাভের ফেসবুক পেজ-এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এক গুচ্ছ ছবি, কলকাতার দর্শকের ভালবাসা, মমতার আপ্যায়ন উচ্ছ্বসিত অমিতাভ। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর তিন লক্ষ সাইবার-ভক্তের কাছে পৌঁছে গেল কলকাতার গুণগান! ইয়ারানা-র স্মৃতিচারণ!
কলকাতার সঙ্গে সুদীর্ঘ ইয়ারানাই যেন এ দিন কয়েক ধাপ এগিয়ে দিলেন অমিতাভ। আইপিএল-সুবাদে শাহরুখ এখন এ শহরের নিয়মিত অতিথি। মিঠুন সম্পর্কে মমতার মন্তব্য, “মিঠুনদা বরাবরই এক রকম। বাংলার নিজের লোক।” অমিতাভ এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, কী করে নিজেকে ‘ঘরের লোক’ করে তুলতে হয়! অমিতাভর বক্তৃতা যে জমি তৈরি করে দিল, তারই উপর দাঁড়িয়ে মমতা বোঝানোর চেষ্টা করলেন, রাজ্যের বিনোদন শিল্পের উন্নয়নে ঠিক কতটা আগ্রহী তিনি।
গত ক’দিন নানা মহল থেকে মমতাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, ফিল্ম জগৎ নিয়ে তাঁর যতটা উৎসাহ রাজ্যে শিল্পায়ন নিয়ে ততটা নয়। ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় শিল্পকর্তাদের সঙ্গে বিজয়া সম্মেলনের আসরে নতুন কথা কিছু না বললেও মমতা নিজেকে শিল্পবান্ধব হিসেবে তুলে ধরার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। এ দিনও বার বার বললেন, রাজ্যের শিল্প মানচিত্রে বিনোদনকে একটা বড় জায়গা দিতে চাইছেন তিনি। তিনটি ফিল্ম সিটি গড়ার পরিকল্পনা করছে রাজ্য। ফেসবুকেও মমতার স্পষ্ট বার্তা, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ব্যবসার ক্ষেত্রে বাংলাকে অন্যতম গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলাই তাঁর লক্ষ্য।
আর, এই লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করার জন্য উপযুক্ত ধরতাই এ দিন দিয়ে গিয়েছেন যিনি, তিনি দীর্ঘদেহী জামাইবাবু। অমিতাভ বচ্চন। |