শহরের নোংরা জলের সরবরাহ কমায় পূর্ব কলকাতা জলাভূমির ভেড়িগুলিতে মাছ চাষে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে মার খাচ্ছে মাছ উৎপাদন।
পূর্ব কলকাতা জলাভূমির ভেড়িগুলিতে কলকাতা পুরসভার ময়লা জল ঢোকানোর জন্য বানতলা ও তপসিয়ায় দু’টি লকগেট আছে। পুরসভা ও স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সহযোগিতায় সে দু’টি চালানোর কথা সেচ দফতরের। নিকাশি খালের উপরে লকগেট দু’টির প্রধান কাজ হল বর্ষায় শহরের বাড়তি জল বার করা এবং নিকাশি বর্জ্য ভেড়িতে ঢুকিয়ে মাছ চাষে সাহায্য করা। গত দশ বছর এই কাজ সুষ্ঠু ভাবে চললেও এ বছর থেকে ওই ব্যবস্থা আর মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ।
ওই জলাভূমি থেকে মাছ মেলে বছরে ১৫০০০ টন। তা ছাড়া, শহরের নোংরা জলে মাছের জন্য খাদ্য থাকে, যা সেগুলির বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক। ভেড়ির লিজ মালিক তথা মৎস্য উৎপাদক সংগঠন ‘ফিশ প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক শশীদুলাল ঘোষ বলেন, “প্রয়োজনীয় জল না পাওয়ায় ভেড়ির গভীরতা কমছে। বাড়ছে জলের তাপমাত্রা। তাই জলে অক্সিজেনের অভাব ঘটে মাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে ওই সব ভেড়িতে মাছ-চাষ আর তেমন লাভজনক থাকছে না।” |
মৎস্যজীবীদের অভিযোগ, লকগেটগুলি খোলা-বন্ধের দায়িত্বে সেচ দফতরের যে আধিকারিকেরা ছিলেন, নতুন সরকার এসে তাঁদের বদলি করে দেয়। তার পর থেকেই দুরবস্থার শুরু। লকগেট দু’টি খোলা রাখলে শহরের নিকাশি বর্জ্যের পুরোটাই চলে যায় কুলটি গাঙ এবং বিদ্যাধরীতে। প্রয়োজন মতো লকগেট বন্ধ করলে সেই জল ঢোকে এই ভেড়িগুলিতে। মৎস্যচাষিদের অভিযোগ, নতুন আধিকারিকেরা সেই প্রয়োজন বুঝতে চাইছেন না।
সেচ দফতরের আধিকারিকেরা অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আধিকারিক বলেন, “বর্ষায় যাতে শহরে জল জমে না থাকে, তা নিশ্চিত করাই আমাদের অগ্রাধিকার। তাই বর্ষাকালে বা কখনও বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলে লকগেট খুলে রাখতে হয়। অন্য সময়ে নিয়মিত লকগেট বন্ধ করি। তাতে মৎস্যজীবীদের প্রয়োজন মেটে কি না বলতে পারব না।”
সমস্যার সমাধানে জাতীয় মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের অর্থানুকূল্যে বানতলায় আরও একটি লকগেট গড়েছে মৎস্য দফতর। কিন্তু ১৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি ওই লকগেটের দায়িত্ব নিয়ে পুরসভা ও সেচ দফতরের মধ্যে চাপান-উতোরে সেটিও গত এক বছরে চালু করা যায়নি। সেটি চালু হলেও সমস্যার কিছুটা সমাধান হত বলে মত মৎস্যজীবীদের।
কলকাতা পুর-এলাকা থেকে রোজ প্রায় ১৩০০ কোটি লিটার বর্জ্য পূর্ব কলকাতার নিকাশি খাল দিয়ে বিদ্যাধরী ও কুলটি গাঙের দিকে যায়। তার এক চতুর্থাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৩০০ কোটি লিটার জল ঢোকে পূর্ব কলকাতার ভেড়িগুলিতে। ভেড়িতে ঢোকার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ওই জল প্রাকৃতিক উপায়ে পরিশোধিত হয়। তাতেই এই জলাভূমির মাছ চাষ হয়। ওই নোংরা জলের সেচেই সেখানকার জমিতে ১৪ হাজার টন ধান, ৫৪ হাজার ৭৫০ টন মরসুমি সব্জির চাষ হয়।
কেবল জলের জোগানই নয়, দ্রুত কমছে ভেড়ির গভীরতাও। কলকাতার নোংরা জলের সঙ্গে রোজ গড়ে ২০৭৬ টন অদ্রাব্য পদার্থ পূর্ব কলকাতা জলাভূমির ভেড়িগুলিতে ঢুকে নীচে জমা হয়ে গভীরতা কমাচ্ছে। সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর এনভায়রনমেন্ট-এর কর্ণধার দীপায়ন দে বলেন, “কলকাতার বর্জ্য জল বছরে ৭ লক্ষ ৩১ হাজার ৫০০ ঘনমিটার নোংরা বা পলি ভেড়িতে জমা করে। ফলে এখন ভেড়ির গড় গভীরতা দাঁড়িয়েছে ৫০০-৭০০ সেন্টিমিটার। এটি চলতে থাকলে ৮-১০ বছরের মধ্যে পূর্ব কলকাতার সব জলাভূমি ভরাট হয়ে শুকিয়ে যাবে।” বছরভর প্রয়োজনীয় জল না পেলে কলকাতার পূর্ব দিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ওই জলাভূমিও বিপন্ন হয়ে পড়বে। |