জঙ্গলমহলে ‘মাও-মুক্তি’র লক্ষ্যে উন্নয়নকে হাতিয়ার করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘোষিত হয়েছিল একের পর এক প্রকল্প। নানা দফতরের মাধ্যমে কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই সব কাজ কি শেষ পর্যন্ত রূপায়িত হচ্ছে? বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষজনের অন্দরে কি পৌঁছচ্ছে উন্নয়নের সুফল?
বাস্তব ছবিটায় ইতিবাচক জবাব মিলছে না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর ২০১১-১২ অর্থবর্ষে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের বরাদ্দ করা ১২ কোটি টাকায় জঙ্গল লাগোয়া ১৪০টি গ্রামে উন্নয়নের নানা কাজ শুরু হয়। কাজ করছিল ঝাড়গ্রাম বন বিভাগ। বন দফতর দু’দফায় পেয়েছিল প্রায় ৬ কোটি টাকা। তারপর আর টাকা আসেনি। ঠিকাদাররা প্রাপ্য পাননি। ফলে, একগুচ্ছ প্রকল্পের কাজ মাঝপথে থমকে গিয়েছে।
বেলপাহাড়ি, শিলদা, বিনপুর, ঝাড়গ্রাম, জামবনি ও গোপীবল্লভপুরের জঙ্গল লাগোয়া এলাকাগুলিতে পানীয় জলের জন্য ৪০টি টিউবওয়েল, সেচের জন্য পাম্প হাউস-সহ ৫৭টি ডিপ-টিউবওয়েল, ৩১টি কমিউনিটি হল, ৩৫ কিমি দীর্ঘ সেচনালা, ২১টি কালভার্ট, ১১টি মার্কেট শেড, ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন তৈরির জন্য বন দফতর গত বছর টেন্ডার ডাকে। ১৭ জন ঠিকাদার কাজের বরাত পান। ৩৮টি পুকুর খননের কাজ শুরু হয়। গত মার্চে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার পর ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দফতরে জমা দেয় বন দফতর। ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে বাকি কাজগুলি শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ চলাকালীন ঠিকাদারেরা বার বার বন দফতরকে তাগাদা দিয়েও টাকা না পেয়ে গত সেপ্টেম্বরে কাজ বন্ধ করে দেন। ঝাড়গ্রামের ডিএফও অশোকপ্রতাপ সিংহের কাছে লিখিত ভাবে বিল আটকে রাখার কারণ জানতে চান ঠিকাদারেরা। বন দফতর জানায়, পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ প্রতিশ্রুতি মতো টাকা না দেওয়ায় বিল মেটানো যাচ্ছে না। তখন পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী তথা ঝাড়গ্রামের বিধায়ক সুকুমার হাঁসদার সঙ্গে দেখা করেন ঠিকাদারেরা। মন্ত্রী জানান, ঝাড়গ্রামের ডিএফও খরচের হিসেব না দেওয়ায় বাকি টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। এরপরই তথ্য জানার অধিকার আইনে ঠিকাদারেরা, ডিএফও-এর কাছে বিষয়টি জানতে চান। দেখা যায়, দু’দফায় খরচের হিসেব পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দফতরে জমা পড়েছে। শেষ পর্যন্ত, পাওনা বিলের দাবিতে গত শুক্রবার ঠিকাদারেরা ঝাড়গ্রামের ডিএফও’কে আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন।
ঠিক কী অবস্থায় পড়ে রয়েছে প্রকল্পগুলি?
গত মার্চে ৪০টি হ্যান্ড টিউবওয়েল, ১১টি কমিউনিটি হল, ২০টি কালভার্ট বন দফতরকে হস্তান্তর করে দেন ঠিকাদারেরা। বাদ বাকি, পানীয় জল ও সেচের জন্য ৫২টি ডিপ টিউবওয়েল-সহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও সেগুলি হস্তান্তর হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। টাকার অভাবে বেলপাহাড়িতে দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন, একটি মার্কেট শেড ও একটি কমিউনিটি হলের কাজ এখনও শুরু করা যায়নি। পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের অতিরিক্ত মুখ্য সচিবের নির্দেশে গত জুন মাসে ঝাড়গ্রামের মহকুমাশাসক বাসব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল প্রকল্পের কাজ ঘুরে দেখে দফতরের সচিবকে রিপোর্ট দেন। সেই রিপোর্টে কয়েকটি কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এরপর গত সেপ্টেম্বরে প্রকল্প পরিদর্শনে আসেন রাজ্যের বিশেষ মুখ্য বনপাল এন ভি রাজাশেখর। তিনি অবশ্য কোনও ত্রুটি খুঁজে পাননি। বিশেষ মুখ্য বনপাল বলেন, “যথেষ্ট ভাল কাজ হয়েছে। আমরা বার বার পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দফতরকে বকেয়া টাকা দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। কেন ওরা বেঁকে বসেছেন বুঝতে পারছি না।” কাজের অগ্রগতি সংক্রান্ত সচিত্র পুস্তিকাও প্রকাশ করেছে বন দফতর।
তবে কেন টাকা পাচ্ছে না ঝাড়গ্রাম বন বিভাগ?
পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী সুকুমার হাঁসদার জবাব, “পশ্চিম মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ার অন্য বন বিভাগগুলিকেও আমরা বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা দিয়েছি। তাঁরা হিসেব বুঝিয়ে দিয়েছেন। ঝাড়গ্রামের ডিএফও হিসেব বুঝিয়ে দিলে বাকি টাকা দেওয়া হবে।”এই চাপানউতোরের মাঝে পড়ে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন জঙ্গলমহলের প্রান্তিক বাসিন্দারা। |