নেই রাজ্যে স্বপ্নের স্কুল গড়ে শিশু-মিত্র পুরস্কার
হুদিন মোরাম না পড়ায় খানাখন্দে ভরা রাস্তায় জমা জল। সঙ্গী প্যাচপ্যাচে কাদা। চারদিকে জঙ্গল। তার মাঝে ছোট্ট একটা গ্রাম ধাপড়া। তারই মাঝে গ্রামের একমাত্র স্কুল। নাম ধাপড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। খানাখন্দের রাস্তা বেয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে স্কুলে পৌঁছলেই মনে হবে যেন মরুদ্যান। আদিবাসী অধ্যুষিত, পিছিয়ে পড়া জঙ্গলমহলেও যে এমন সুন্দর প্রাথমিক স্কুল থাকতে পারে, তা যেন ভাবনার অতীত। এই সেদিনও অশান্ত জঙ্গলমহলে রক্ত ঝরেছে, রাস্তায় পড়ে থেকেছে লাশ। বাড়ি পুড়েছে, ভাঙচুর হয়েছে, গুলি-বন্দুকের দাপাদাপিতে কেঁপেছে গোটা এলাকা। অথচ তাতে এই স্কুলের ছন্দপতন হয়নি। নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন কর্তৃপক্ষ। আর সেই অধ্যবসায়ের জোরেই রাজ্য সরকারের শিশু-মিত্র পুরস্কারের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে শালবনি থানার ধাপড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়।
স্কুলে কী নেই? ঝকঝকে রান্না ঘর, শৌচালয়, বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য সাব-মার্সিবল পাম্প। সেই জল আরও বিশুদ্ধ করতে বালতিকে ট্যাঙ্ক বানিয়ে তার সঙ্গে পাইপ জুড়ে লাগানো হয়েছে ফিল্টার।
হাত মুখ ধোওয়ার জন্য বেসিন। সামনে রকমারি ফুলের গাছ। পাঁচিলে ও স্কুলের দেওয়ালে ‘মেয়ে হবে কন্যারত্ন/ পেলে শিক্ষা, পেলে যত্ন,’ বা ‘বিদ্যালয়ে প্লাস্টিকের নিয়ন্ত্রণ/ নির্মল পরিবেশে করব পঠন পাঠন’-এর মতো হরেক স্লোগান। খেলার জন্য দোলনা, স্লিপ কিছুরই অভাব নেই। স্কুল চত্বরে বা ক্লাসঘরে, এমনকী বাগানেও সামান্যতম আবর্জনা পাওয়া যাবে না। আবর্জনা ফেলার জন্য রয়েছে দু’ধরনের বালতি। একটিতে লেখা, ‘আমি পচি না,’ অন্যটিতে ‘আমি পচি’।
এ ভাবেই সেজে উঠেছে ধাপড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। কচিকাঁচাদের পড়াচ্ছেন
স্কুলের একমাত্র শিক্ষক বিশ্বজিৎ মাহাতো। রামপ্রসাদ সাউয়ের তোলা ছবি।
এভাবে ছোট পড়ুয়াদের পচনশীল ও পচনশীল নয়, দু’ধরনের জিনিসও চিনিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
স্কুলে ৪৬ জন ছাত্রছাত্রী। একটি ক্লাসঘরেই ক্লাস হয়। শিক্ষকও মাত্র এক জন। তিনিই প্রধান শিক্ষক। সেই বিশ্বজিৎ মাহাতোর উদ্যোগেই কার্যত নেই রাজ্যে গড়ে উঠেছে এমন একটি স্কুল। সবেতেই তীক্ষ্ন নজর বিশ্বজিৎবাবুর। আর তাঁকে সর্বতো ভাবে সাহায্য করেন গ্রামের মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দা আনন্দ মাহাতো, দুর্গাপদ মাহাতোরা বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। খেটে খাই। অর্থের অভাবে পড়তে পারিনি। তাই এই স্কুল নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। স্কুলের প্রতিটি কাজে আমরা নিখরচায় শ্রম দিই। তা সে পাঁচিল তোলার কাজ হোক বা স্কুলের সামনে মাটি ভরাট করা। স্কুলের কাজে গ্রামের সকলেই এক পায়ে খাড়া।”
কথাটা যে একশো ভাগ সত্যি, বোঝা যায় মিড ডে মিল রাঁধতে আসা স্ব-সহায়ক দলের সদস্যদের দেখেও। সকলের পরনে পরিষ্কার শাড়ি। তরকারি কাটার পরেও রান্নাঘরে এতটুকু বর্জ্য নেই। রান্নার দায়িত্বে থাকা ঝুমি মাহাতো বলেন, “আমারও ছেলে এই স্কুলেই পড়ে। আমরা যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকি তাহলে তো বাচাগুলোদরই ক্ষতি।” এ সব দেখে শিখছে ছাত্রছাত্রীরাও। চতুর্থ শ্রেণির রাজু মাহাতোর কথায়, “স্কুলে যেমন ফুলের গাছ লাগাই, বাড়িতেও লাগিয়েছি। পরিবেশ ভাল থাকলে শরীর সুস্থ থাকে।” এই স্কুলে একজন ছাত্রকেও পাওয়া যাবে না যার ইউনিফর্ম নোংরা। স্কুলের বারান্দায় জুতোর র্যাক দেখেও তাজ্জব বনতে হয়। সার দিয়ে গুছিয়ে রাখা প্রতিটি জুতো। পড়াশোনাতেও চেষ্টার খামতি নেই। চতুর্থ শ্রেণির গজমতি মাহাতো, তৃতীয় শ্রেণির রাজীব মাহাতোরা বলে, “প্রতিদিন সকালে উঠেই দাঁত মেজে পড়তে বসি। ভাল করে স্নান করে স্কুলে আসি। পড়ার ফাঁকে বাড়ি ও স্কুল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখারও কাজ করি।”
প্রত্যন্ত একটি গ্রামে, তা-ও আবার পিছিয়ে পড়া জঙ্গলমহলে কী করে সম্ভব হল এ সব? প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “গ্রামের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেই যাবতীয় কাজ করা হয়। ওদেরই বাড়ির ছেলেমেয়েরা ভাল থাকবেন, এটা বোঝাতে সক্ষম হওয়ার ফলেই এতে সাফল্য এসেছে।” এ ভাবে যে সব স্কুল ছাত্রদের সত্যিকারের বন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছে, প্রতিটি জেলা তেমনই ২টি করে স্কুলকে শিশু-মিত্র পুরস্কার দিচ্ছে রাজ্য সরকার। সেই তালিকায় পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর গ্রামীণ থানার রূপনারায়ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে রয়েছে ধাপড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ও। সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পের জেলা প্রকল্প আধিকারিক শাশ্বতী দাস বলেন, “অশান্ত জঙ্গলমহলে হয়েও ধাপড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় যা করেছে তা দৃষ্টান্ত। পুরস্কার বাবদ ওই স্কুলকে ২৫ হাজার টাকা দেবে রাজ্য সরকার।”
সদিচ্ছায় যে সবই হয়, এই স্বপ্নের স্কুল তার প্রমাণ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.