লাল বা সবুজ আবিরটুকু না হয়, না-ই থাকল। দশ আঙুলে ঘন নীল নেলপালিশ তো রয়েছে। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে তাই নিজের দু’হাত মেলে ধরলেন প্রভাতী চৌধুরী।
জায়ান্ট স্ক্রিনে সেই মুহূর্তে ‘ভিকট্রি স্পিচ’ দিতে বারাক ওবামার আবির্ভাব ঘটছে। সেটা বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার কলকাতা, নাকি গভীর রাতের ডেমোক্র্যাট-ঘাঁটি শিকাগো, তখন গুলিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের লিঙ্কনরুম কাঁপছে মুহূর্মুহূ হাততালিতে। লাল বা সবুজ ভুলে একটি বেলা, আমেরিকার জয়ের রঙে রং মেশাতে ব্যস্ত কলকাতা।
কলকাতাতেও খেলাচ্ছলে ওবামাসাহেবের জনপ্রিয়তার পরখ হল। আমেরিকায় ভোটগণনার সময়ে এ শহরে মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত অভিনব প্রাতরাশের আসরেও অতিথিরা গোপন ব্যালটে তাঁদের রায় দিলেন।
না, রিগিংয়ের জো নেই। ভোটদানের খোপ থেকে বেরোতেই জামায় ‘আই ভোটেড’ লেখা কাগজ সেঁটে দেওয়া হচ্ছিল। বেলা ১০টা নাগাদ দিল্লি থেকে ভিডিও কনফারেন্সে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল হবু বিজয়ীর নাম ঘোষণা করলেন। তার আগেই কলকাতাও ওবামার প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব কবুল করেছে। কলকাতায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল ডিন থম্পসন অবশ্য একটু তাজ্জব, গ্রিন পার্টির প্রার্থীও কী ভাবে দু’টো ভোট পেয়ে গিয়েছেন।
কলকাতার মজার ভোটাভুটি গোপনে হলেও দু-দু’টো বাটিতে গাধা ও হাতি আঁকা ব্যাজ সাজিয়ে রাখা ছিল। যে যার পছন্দের প্রতীক বেছে নিন। তা-ই দেখে শীতলার বাহন গাধা আর বিশ্বকর্মার হাতি নিয়েও ফাজিল বাঙালির মস্করা শুরু। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল, গাধা ফুরিয়ে গেলেও রিপাবলিকানদের হাতির বাটির অর্ধেকও খালি হয়নি। |
কাকভোরে লিঙ্কনরুমে ঢুকতে গিয়ে ইউএসআইএস-এর ডিরেক্টর জেফ্রি রেনোর মুখে যেটা শোনা গেল, তার জন্যও আম বাঙালি সচরাচর প্রস্তুত থাকে না। “এসো, এসো ইট্স ফান!” ভোট-গণনার মধ্যে আবার মজাটা কীসের? এ দেশ বা রাজ্যে ভোট নিয়ে প্রার্থী ও সমর্থকদের ‘গেল গেল’ ভাব বা ‘রে রে’ করা মূর্তিই তো সাধারণত দেখে এসেছে কলকাতা।
কিন্তু লিঙ্কনরুমে মজারই ছড়াছড়ি।
তখনও ফল প্রকাশের গোড়ার পর্ব। মিট রোমনির সঙ্গে লড়াইয়ে ওবামা কিছুটা পিছিয়ে। মডার্ন হাইস্কুলের ক্লাস ইলেভেন, শিবানী অগ্রবাল হাত-পা নেড়ে ওবামার বিদেশ নীতির মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছিল। তার সওয়ালের ফাঁকে এক দূতাবাস কর্মীর সহাস্য প্রশ্ন, তুমি নিশ্চয়ই স্কুলে বিতর্কসভার চ্যাম্পিয়ন?
কর্মসূত্রে এ শহরে এসেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী লিজা ও এমা। দু’জনে দুই যুযুধান-শিবিরের সমর্থক। পাশাপাশি বসে জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে এক বার তাকিয়েই থালা ভর্তি মাফিন, সিনামন রোল আর হ্যাম স্যান্ডউইচ সাবাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁরা।
ভোটে দারুণ লড়লেও কলকাতার ভিড়ে রোমনির সমর্থক তেমন খুঁজে পাওয়া গেল না। সিআইটি রোডের মীনাক্ষি লাহিড়ি মালাহান এখন মার্কিন নাগরিক। ফ্লোরিডায় নিজের ভোটটা ‘অ্যাবসেন্টি ব্যালট’-এর মাধ্যমে দিয়েছেন। মীনাক্ষি প্রথমটা ওবামাকে নিয়ে তাঁর হতাশার কথাই বলছিলেন। পরে হাততালি দিয়ে বলতে শুরু করলেন, “আর একটা সুযোগ দেওয়াই দরকার ছিল।”
ওবামাকে সমর্থনের পিছনে বিচিত্র যুক্তির ছড়াছড়ি। তিন দশক আমেরিকাবাসী নিউ ইয়র্কের রবীন গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, অপ্রাপ্তি থাকলেও যুদ্ধ-বিরোধিতার স্বার্থে ওবামাই ভরসা! আশৈশব আমেরিকাবাসী, ওয়াশিংটনের মিমি মুখোপাধ্যায় আবার জ্যোতিষের ভিত্তিতে বিজয়ীকে বেছেছেন। বললেন, “আমি আগেই গণনা করেছিলাম। ওবামা পিছিয়ে থাকার সময়েই টুইটারে লিখে দিই।”
ফল প্রকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘরের এক ধারে আমেরিকার প্রকাণ্ড ম্যাপে স্টেটগুলো লাল বা নীল হয়ে উঠছিল। দূতাবাসের রাজনীতি ও অর্থনীতি-বিষয়ক কনসাল ক্লিন্টন ব্রাউন ওরফে ট্যাড তাঁর নিজের আইপ্যাডে হাড্ডাহাড্ডি স্টেটগুলোর হিসেব কষছিলেন। ফ্লোরিডা, ওহায়ো, ভার্জিনিয়ার একটায় জিতলেই ওবামাকে ঠেকানো যাবে না! ট্যাড বললেন, “দেশে থাকলে এখন ফ্লোরিডায় কী হয়েছে দেখেই ঘুমোতে চলে যেতাম।” লোরেটোর কলেজছাত্রীদের দলটা ওবামার কট্টর সমর্থক। হার স্বীকার করতে রোমনি বস্টনে ক্যামেরার সামনে আসতেই বিস্ময়, “দিনভর ভোটের ধকলের পরে এই মাঝরাত্তিরেও চোখে-মুখে কোনও ছাপ নেই। ভাবা যায়!”
অ্যারিজোনার ষাটোর্ধ্ব দম্পতি সুব্রত ও প্রভাতী চৌধুরী কামারহাটিতে পারিবারিক পুজো উপলক্ষে কলকাতায় এসেছিলেন। দু’জনেই ডেমোক্র্যাটদের নীলরঙে সেজেগুজে কাকভোরে কামারহাটি থেকে বেরিয়েছেন। সপরিবার ওবামাকে স্ক্রিনে দেখে তাঁরা ডগমগ। “ও মা, সাশা আর মালিয়াটা ক-ত্ত বড় হয়ে গিয়েছে!”
আমেরিকার লাল-নীলের যুদ্ধের কুশীলবেরা এখন বাঙালির ঘরের লোক। |