|
|
|
|
বলে গিয়েছিলেন, সবাই ভাল থাকবেন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নবদ্বীপ |
পাঁচ রবিবার আগের এক বিকেল। ৩০ সেপ্টেম্বর। নবদ্বীপ বকুলতলা প্রাক্তনীর ২০০ আসনের সভাঘর উপচে পড়া ভিড়। সকলে অধীর আগ্রহে তাঁর অপেক্ষায়। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ তিনি এলেন ধীর পায়ে। মুখোমুখি তাঁকে অর্থাৎ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে পেয়ে ভক্তরা আপ্লুত। স্মৃতি থেকে অর্নগল আবৃত্তি-“যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াব।” ঘণ্টা দেড়েক সকলকে সম্মোহিত করে রাখার পর তিনি চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, “সবাই ভাল থাকবেন।”
পাঁচ রবিবার পরে সেই একই সভাঘর। একই উদ্যোক্তা। মঞ্চে উপবিষ্ট সুনীল। তবে সশরীরে নয়। ছবিতে। দিকশূন্যপুরে চলে গিয়েছেন যে কবি, তাঁকে স্মরণ করে কলকাতার রবীন্দ্রসদনে যে অনুষ্ঠান হয়েছে, তারই মতো সুনীল স্মরণের উদ্যোগে বেজে চলে যন্ত্রে ধরে রাখা সুনীল স্বর-“এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি।” |
|
|
পাঁচ রবিবার আগে (বাঁ দিকে)। এই রবিবার। —নিজস্ব চিত্র। |
|
নবদ্বীপ বকুলতলা প্রাক্তণ ছাত্র সম্মিলনীর আয়োজনেই ৩০ সেপ্টেম্বর নবদ্বীপে এসেছিলেন সস্ত্রীক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তার ঠিক তিন সপ্তাহের মাথায় মারা যান তিনি। ৪ নভেম্বর রবিবার সুনীল সুনীল স্মরণের আয়োজন করেছিল ওই সংগঠনটি। এ দিনের অনুষ্ঠানে বাজানো হয় আগের অনুষ্ঠানে কবির আবৃত্তি করা স্বকন্ঠের কবিতা। উদ্যোক্তাদের তরফে চিকিৎসক বিক্রম পাল বলেন, “ওই অনুষ্ঠানকে ঘিরেই ওনার সঙ্গে আমার আলাপ। এত বড় মাপের মানুষ এত সহজে আমাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন, তা ভাবতেই পারছি না। সে দিনের ছবিটা চোখের সামনে ভাসছে।” সে দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সীমা ঘোষ। এ দিন সুনীল স্মরণে এসে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। সীমাদেবী বলেন, “এত তাড়াতাড়ি স্মরণ সভায় আসতে হবে সে দিন কল্পনাও করিনি।”
রবিবার বৃষ্টির ভ্রুকূটিকে উপেক্ষা করে নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর-ধুবুলিয়া-শান্তিপুর সর্বত্রই ছিল সুনীলময়। কোথাও তাঁকে নিয়ে আলোচনা, কোথাও বা স্মৃতিচারণা, কবিতা পাঠ, আর কোথাও বা হয়েছে বই প্রকাশ।
শনিবার বিকেলে কৃষ্ণনগরের “পরম্পরার” আয়োজনে অরবিন্দ ভবনে এক আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত হয়। “সুনীল প্রহর” শীর্ষক ওই আলোচনা সভায় কবি সম্পর্কে নানা কথা বলেন তাঁরই ঘনিষ্ট সুধীর চক্রবর্তী। “এই প্রজন্মের চোখে সুনীল” প্রসঙ্গে বলেন তরুণ কলেজ শিক্ষক ছন্দম চক্রবর্তী। কাকাবাবুর একনিষ্ঠ ভক্ত কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র জয়ন্ত বিশ্বাস বলেন কিশোর সাহিত্যিক সুনীলের কথা। সুধীর চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণে উঠে আসে অন্য সুনীলের কথা। যে সুনীল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ঝুঁকি নিয়েও বাংলা ভাষা চর্চার জন্য আমেরিকা থেকে ফিরে আসেন দেশে। উঠে আসে অভ্যাগতদের সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্যেই অনর্গল লিখে যাওয়ার ক্ষমতা। পরম্পরার সম্পাদক বিশ্বনাথ ভদ্র বলেন, “শনিবার সন্ধ্যায় বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে এত মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা আজও অমলিন।”
রবিবার দুপুরে ধুবুলিয়ার ‘কথাশিল্প’ ও ‘তিতলি’-র আয়োজনে এক স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় মেঘছায়া ভবনে প্রকাশিত হয় “মিষ্টিমুখ” পত্রিকার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণ সংখ্যা। এই সংখ্যায় সুনীলের নিজের লেখা একটি কবিতা ছাড়াও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, সুধীর চক্রবর্তী, উৎপলকুমার বসু-সহ সতেরো জনের সুনীলকে নিয়ে লেখা গদ্য ও কবিতা ঠাঁই পেয়েছে। আয়োজকদের তরফে শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ বলেন, “বিকেলে সুনীলের কবিতা পাঠ হয়। আলোচনা হয়েছে তাঁর জীবন নিয়েও। অনেকেই কবিকে নিয়ে লেখা স্বরচিত কবিতাও পাঠ করেন।”
|
দিকশূন্যপুরের কবিকে কুর্নিশ গ্রামবাংলার
নিজস্ব প্রতিবেদন |
পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার সাহিত্যসংস্থা ‘কথা-ছন্দ’ গঠনের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন সুনীলবাবু। তাই রবিবার কলকাতার রবীন্দ্রসদনে সুনীল-স্মরণে মূল অনুষ্ঠান হচ্ছিল যখন, তখন এগরাতেও এই সাহিত্যিকের স্মৃতিচারণ করল ‘কথা-ছন্দ’।
শনিবারই শুরু হয়েছিল সংস্থার দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান। সংস্থার ভবনেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করা হয়। তাঁর লেখা কবিতা, গদ্য পাঠের পাশাপাশি সাহিত্যে অবদান নিয়ে আলোচনা হয়। সঙ্গে অবশ্যই এই সংস্থা গঠন ও বিকাশে তাঁর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়। সংস্থার সম্পাদক চক্রধর দাস বলেন, “কথা-ছন্দ সুনীলদার কাছে শুধু ঋণী নয়, তাতেই পরিপুষ্ট। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাননি, আমাদের মধ্যেই আছেন।” তিনি জানান, সংস্থার নিজস্ব ছোটদের পাঠাগার ও পাঠাগারের মুখপত্র ‘ধ্রুবতারা’ গড়ে তোলার পিছনে মুখ্য ভূমিকা ছিল সুনীলবাবুর। তাঁর উৎসাহ, পরামর্শ ও নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া প্রতিনিয়ত ভরসা জুগিয়েছে বলে জানান চক্রধরবাবু। ব্যক্তিগত উদ্যেগেও সুনীলবাবু পাঠাগারের জন্য বহু দুষ্প্রাপ্য বই ও পত্রিকা দিয়েছেন। সংস্থার সদস্য তরুণ এক কবি বলেন, “সুনীলবাবু সব সময় বলতেন, যে কাজে হাত দিয়েছ, তাতে অনেক বাধা। কিন্তু ধৈর্য হারিও না, সহনশীলতা বাড়াও। নবীনদের দলে টেনে বাংলা ভাষার প্রসারে নিরন্তর চেষ্টা চালানোর পরামর্শ দিতেন তিনি।” |
|
|
|
এগরা ও তমলুকে সুনীল স্মরণ। ছবি তুলেছেন কৌশিক মিশ্র ও পার্থপ্রতিম দাস। |
|
রবিবারই কাঁথিয়ে দিঘলপত্র অ্যাকাডেমি আয়োজিত সারা বাংলা লিটল ম্যাগাজিন মেলাতে প্রয়াত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণা করেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কবি-সাহিত্যিকরা। কাঁথি বীরেন্দ্র স্মৃতি টাউন হলের এই স্মরণসভায় নীরবতা পালনের পরে সুনীলকে নিয়ে লেখা কবিতা পাঠ করেন প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের কবিরা। কবি দুরন্ত বিজলী ও মনোরঞ্জন খাঁড়া প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক অমলেন্দু বিকাশ জানা। প্রায় ৭০-৭৫ জন কবি সাহিত্যিকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কবি দীপক হোতা ও ইভা মাইতি। প্রয়াত কবি বীতশোক ভট্টাচার্যকেও স্মরণ করা হয় অনুষ্ঠানে। দিঘলপত্র অ্যাকাডেমির উদ্যোগে শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছিল চার দিন ব্যাপী সারা বাংলা সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলা। উদ্বোধন করেন কবি শান্তিরঞ্জন কর্মকার। উপস্থিত ছিলেন কবি অমৃত মাইতি, শিশির চক্রবর্তী ও বিশিষ্ট টেরাকোটা শিল্পী রামকুমার মান্না।
পূর্ব মেদিনীপুর সাহিত্য সম্মেলনীর উদ্যোগে তমলুকের স্টীমারঘাটে ব্রাইট ফিউচার হলে সুনীল-স্মরণ হয়। রবিবার বিকেলের এই স্মরণসভায় প্রয়াত সাহিত্যিকের জীবন ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে আলোচনা করেন মেদিনীপুর কলেজের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক সুস্নাত জানা, তমলুক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক প্রণব বাহুবলীন্দ্র, মহিষাদল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হরিপদ মাইতি, ময়না কলেজের অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক আশুতোষ দাস প্রমুখ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা আবৃত্তি করেন ভবানীপ্রসাদ অধিকারী, গৌতম ভট্টাচার্য, কৃতিসুন্দর পাল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন হরিপদবাবু। সাহিত্য সম্মেলনীর তরফে রাজর্ষি মহাপাত্র বলেন, “বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রয়াণে আমরা মর্মাহত। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই স্মরণসভা।”
|
রাজ্যের অন্যত্র এই দিন সুনীল স্মরণ হয়েছে |
• ইতিপূর্বেই অবশ্য পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-বীরভূমের বিভিন্ন জায়গায় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণে নানা অনুষ্ঠান হয়েছে। গত রবিবারই পুরুলিয়ার সিমলাপাল কৃষ্টি পরিষদ সুনীল-স্মরণে একটি সাহিত্যসভা করে। বিক্রমপুরের বাপুজী সঙ্ঘের সভাকক্ষে হওয়া ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন এলাকার বহু কবি ও গল্পকার। অন্য দিকে, গত বৃহস্পতিবার বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মনসাতলায় কবি-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের বিজয়া সম্মেলনের আড্ডায় স্মরণ করা হয় প্রয়াত কবিকে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিকাশ দাস, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত পণ্ডিত, হরিপ্রসন্ন মিশ্র প্রমুখ কবি-লেখক। বিষ্ণুপুর যদুভট্ট মঞ্চের অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল শনিবার। উদ্বোধন করেন রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাপাধ্যায়। সভাপতিত্ব করেন নরওয়েবাসী সাহিত্যিক নির্মল ব্রক্ষ্মচারী। বিভিন্ন জেলার ৪৬০ জন প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন।
• আসানসোল মহীশিলা সঞ্চয়ন পাঠাগারে ‘মুক্তপ্রাণে’র উদ্যোগে এ দিন হল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণ অনুষ্ঠান। তাঁর লেখা গদ্য সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন মহীশিলা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশিস দাস। কবি সুনীলকে নিয়ে কথা বলেন কবি সুভাষ মণ্ডল। পাঠ করা হয় কবির কবিতাও।
• বিষ্ণুপুর যদুভট্ট মঞ্চে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সমিতি স্মরণ করা হয় তাঁকে। মুক্তপ্রাণের উদ্যোগে বর্ধমানের আসানসোল মহিশীলা সঞ্চয়ন পাঠাগারে সুনীল স্মরণ হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার কথাছন্দ এবং কাঁথির দীঘলপত্র একাডেমি কবিকে স্মরণ করে অনুষ্ঠান করে। পূর্ব মেদিনীপুর সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোগে তমলুকে স্টিমার ঘটে ব্রাইট ফিউচার হলে কবিকে কবিতায় স্মরণ করা হয়। |
|
|
|
|
|