দাদার বদলে দিদি এসেছেন। ট্র্যাডিশন কিন্তু বদলায়নি! শিল্প এবং শিল্পীর স্বাধীনতায় দাদাগিরি (নাকি দিদিগিরি) ফলানোর পরম্পরা পশ্চিমবঙ্গে অপরিবর্তিত!
আরও অনেক কিছুর মতো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার শিল্প ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে খবরদারির পাঠ নিয়েছেন সিপিএমের পুরনো বই থেকে! কী ভাবে? নানা অছিলায় বাম জমানায় বার বার শাসকের রোষের মুখে পড়েছে নাটক, চলচ্চিত্র। কখনও বলা হয়েছে, জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাবে। কখনও অভিযোগ করা হয়েছে, কমিউনিস্ট ‘আইকনে’র অবমাননা হচ্ছে। কখনও আবার বলা হয়েছে, নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না সিনেমা বা নাটক। সংস্কৃতিপ্রেমী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের (যাঁর হাতে আগাগোড়া ছিল তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরও) পুলিশ গিয়েছে ব্রাত্য বসু বা অর্পিতা ঘোষের নাটকের শো বন্ধ করতে। এ তো বাহ্য। তলে তলে এলাকায় এলাকায় সংগঠকদের চাপ দিয়ে বিরোধী বলে চিহ্নিতদের নাটকের শো বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে ভূরি ভূরি। স্টার থিয়েটারে ‘তিন কন্যা’র প্রদর্শন সংক্রান্ত নাট্য-রঙ্গ দেখে সংস্কৃতি জগতের উপলব্ধি, জমানা বদলেছে। কিন্তু কোনও পরিবর্তনই হয়নি। বরং সিপিএমের দেখানো পথ তাদের উত্তরসূরির আমলে সুরক্ষিতই আছে!
আলিমুদ্দিন অবশ্য মনে করে, শিল্পীর যেমন সৃষ্টির স্বাধীনতা আছে, তেমনই গণতন্ত্রে তা নিয়ে প্রতিবাদের অধিকারও আছে। সেই প্রতিবাদ কোনও রাজনৈতিক দলও জানাতে পারে। কিন্তু কোনও ভাবেই মসনদে বসে কোনও সরকার সংস্কৃতিতে বাধা দিতে পারে না। দলের আপত্তি বা প্রতিবাদ আর সরকারের বাধা দেওয়াটা এক ঘটনা নয়। সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, তাঁরা দল হিসেবে যা-ই করে থাকুন, তাঁদের সরকার বিরোধিতা সহ্য করবে না বলে কোনও ছবি বা নাটকের কণ্ঠরোধ করতে যায়নি! সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী বলছেন, “রাজনৈতিক দল তার মতাদর্শ বা ভাবনাচিন্তা থেকে কোনও প্রতিবাদ করতেই পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের কাজ সরকার করবে কেন?” তা হলে বাম জমানায় এত ছবি-নাটক কোপে পড়েছিল কী ভাবে? তা-ও চলচ্চিত্রের সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়া পরেও? এর কোনও সদুত্তর নেই। |
নাট্য-ব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন কিন্তু মনে করেন, পার্টিই বন্ধ করুক বা সরকার, তাতে দোষ স্খালন হয় না।
বাম জমানায় বিপুল বিতর্ক বেধেছিল কলকাতা উৎসবে আসা রুশ পরিচালক আলেকজান্ডার সকুরভের ‘টরাস’ ছবিটি নিয়ে। লেনিনকে অবমাননা করা হয়েছে এই ছবিতে এই যুক্তি দেখিয়ে প্রতিবাদে নেমে পড়েছিল সিপিএমের যুব ও ছাত্র সংগঠন ডিওয়াইএফআই এবং এসএফআই। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও ছবিটির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছিলেন, সকুরভ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক বলেই লেনিনের মতো ব্যক্তিত্বকে নিয়ে তথ্যবিকৃতি ঘটানোর অধিকার তাঁর জন্মায় না! সিপিএমের ছাত্র-যুবদের প্রতিনিধিদল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর কাছে গিয়ে ছবিটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছিল। পরে লন্ডনের উৎসবে প্রিন্ট পাঠাতে হবে, অজুহাত দিয়ে কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ছবিটি তুলে নেওয়া হয়। শিল্প ও সংস্কৃতি জগতের প্রশ্ন, এখন না হয় ‘তিন কন্যা’কে বাধা দেওয়া নিয়ে হইচই হচ্ছে। কিন্তু ২০০১ সালের সেই টরাস-কাণ্ডের জন্য বিমানবাবুর দুঃখপ্রকাশ করবেন কি?
বিমানবাবু অবশ্য বলছেন, “এখন যা হচ্ছে, তার সঙ্গে সেই ‘টরাস’ ছবিটির কোনও তুলনা টানা যায় না। সেখানে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছিল। তখন যা বলেছিলাম, এখনও তা-ই মনে করি।” সে দিন যাঁরা প্রতিবাদের সামনের সারিতে ছিলেন, সেই সিপিএম নেতা তন্ময় ভট্টাচার্যের দাবি, তাঁরা অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন। শো বন্ধ করতে নয়।
কিন্তু তন্ময়বাবুদের এই বক্তব্য মানতে নারাজ অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, প্রক্রিয়া যা-ই হোক, বহু ক্ষেত্রেই নানা ভাবে আটকে দেওয়া হয়েছে নাটকের শো বা বাধা দেওয়া হয়েছে সিনেমা প্রদর্শনে। সেই অভিযোগে কাঠগড়ায় উঠতে হচ্ছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও। জ্যোতিবাবুর মুখ্যমন্ত্রিত্বে দমিনিক লাপিয়্যেরের ‘সিটি অফ জয়’ অবলম্বনে ছবিটির নির্মাণে যখন বাধা দেয় সিপিএমের বাহিনী, বুদ্ধবাবু তখনও তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের দায়িত্বে। |
প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, বাংলার দারিদ্রকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য করা হবে কেন? বিতর্ক হয়েছিল ‘লা ন্যুই বেঙ্গলি’ নামক ফরাসি ছবি তৈরি ঘিরেও। সেখানেও জড়িয়ে ছিল বুদ্ধবাবুর নাম। ‘হারবার্ট’ বা ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ নন্দনে বন্ধ হয়েছিল বুদ্ধবাবুর মুখ্যমন্ত্রিত্বেই। শুধু তা-ই নয়, কৌশিকবাবু যেমন বলছিলেন, ২০০৭-২০০৮ সালে যখন তাঁরা বাম সরকারের বিরোধী প্রচারে রত, তখন তাঁদের নাটকের কল শোয়ের সংখ্যা মারাত্মক ভাবে কমে গিয়েছিল। বলছিলেন, “প্রমাণ করা যাবে না। কিন্তু নানা জায়গায়, নানা ভাবে বাধা এসেছে নাটক প্রদর্শনের ক্ষেত্রে।” তাঁর বক্তব্য, শুধু তিনিই নন, সেই সময় ভুক্তভোগী আরও অনেকে। এমনই অভিযোগ ছিল একটি নাটকে লেনিন-বিরোধী সংলাপের ক্ষেত্রেও। নাট্য দলের অনেকেই বলেছেন, ওই সংলাপের সময় সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরা উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করে বাধা দিতেন।
পরবর্তী কালে অবশ্য যাতে অর্পিতা ঘোষের ‘পশুখামার’-এর প্রদর্শন বন্ধ না হয়, সে জন্য হস্তক্ষেপ করেছিলেন বুদ্ধবাবু নিজেই। দলের এক সাংসদকে তার জন্য ভর্ৎসনাও করেছেন। তবে পরিস্থিতি তখন একেবারেই ভিন্ন। বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার চলছে, মমতা আলিমুদ্দিনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন! সিপিএমেরই কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য এ দিন একান্ত আলাপচারিতায় মেনেও নিয়েছেন, এই ধরনের কাজ তাঁদের দলের উচিত হয়নি। তাঁর কথায়, “কেউ যদি ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েও থাকে, তার বিচার করার জন্য মানুষ আছেন।”
কিন্তু রাজ্যে পরিবর্তনের পরেও কেন বদলাল না বাম জমানার সেই পরম্পরা? শিক্ষামন্ত্রী তথা নাট্য-ব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু কিন্তু জানিয়েছেন, তিনি শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। এই সূত্রেই ব্রাত্য বাম জমানার ঘটনা মনে করিয়ে জানান, ২০০২ সালে স্থানীয় চাপে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল তাঁর লেখা নাটক ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’-এর শো। মমতাপন্থী নাট্য-ব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষের আপত্তি রাজ-রোষ শব্দবন্ধটিতে। তাঁর বক্তব্য, “২০১১ সালে আমার ‘পশুখামার’ নাটকটি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের নির্দেশে পুলিশ এসে বন্ধ করে দিয়েছিল! কিন্তু ‘তিন কন্যা’ যদি একটি হলে বন্ধ হয়ে থাকে এবং অন্য হলে চলে, তা হলে তাকে রাজ-রোষ বলব কেন?” তাঁর কথায়, “তিন কন্যা নিয়ে স্টার থিয়েটারে কী ঘটেছে, এই নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। সেটা স্পষ্ট হলে হয়তো আমিও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারতাম।” তবে অর্পিতাও মনে করেন, “শিল্পের স্বাধীনতা থাকবে, এটাই গণতন্ত্র।” তাঁর বক্তব্য, “আশা করব, এই সরকার সে পথে হাঁটবে না। যদি সত্যিই তেমন কিছু হয়ে থাকে, দুর্ভাগ্যজনক। ভবিষ্যতে যদি তেমন কিছু হয়, তখন সেই ভাবে ভাবব।”
অর্পিতা ভবিষ্যতের কথা বলছেন। ভুক্তভোগীরা কিন্তু এখনই বাম জমানার সংস্কৃতি-শাসনের ছায়া দেখছেন। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ নয়, এমন বহু নাট্যদলের অভিযোগ, তাঁরা হয় হল পাচ্ছেন না, নয়তো পাচ্ছেন না শোয়ের ভাল সময়। তা হলে?
কৌশিকবাবুর কথায়, জমানা পাল্টে গেলেও সব বদলায় না। এ ক্ষেত্রেও ব্যাটন হাতবদল হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, কোনও দলই সমালোচনা শুনতে চায় না। পরিবর্তনেও যে ট্র্যাডিশনটা ভাঙল না, সেটাই বাংলার মানুষের দুর্ভাগ্য। |