সেট টপ বক্স না-লাগালে বোঝা সম্ভব নয়, ঠিক কত গ্রাহক কেব্ল টিভি দেখছেন। আসল সংখ্যার তুলনায় তা বহু গুণ কমিয়ে দেখানোর সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। ফলে সম্প্রচারকারীর থেকে প্রমোদ-কর যা পাওয়া উচিত, রাজ্যের হাতে আসছে তার বহু গুণ কম। এই লোকসান মেটাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার চার মাসের মধ্যে অর্থ দফতর বিস্তারিত প্রকল্প তৈরি করেছিল। কিন্তু এখন সেই প্রকল্প-প্রস্তাব ঠান্ডা ঘরে বলে মহাকরণ-সূত্রে জানা গিয়েছে।
সেট টপ বক্স না-থাকায় রাজ্য কোষাগার কত বাড়তি আয়ের সুযোগ হারাচ্ছে, অর্থ দফতরের বিশেষ রাজস্ব আদায় শাখার তৈরি প্রস্তাবটিতে তারও ইঙ্গিত ছিল। বলা হয়েছিল, বর্তমানে কেব্ল টিভি খাতে রাজ্য প্রমোদ-কর হিসেবে আদায় করছে খুব বেশি হলে বছরে ৪ কোটি টাকা। সেট টপ বক্স মারফত ডিজিট্যাল সম্প্রচার চালু হলে যা শুধু কলকাতা মেট্রো-এলাকাতেই দাঁড়াবে ৫০ কোটিরও বেশি! আর কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা মানলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে গোটা রাজ্যে টেলিভিশনে ডিজিট্যাল সম্প্রচার শুরু হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে সাড়ে তিনশো কোটি টাকারও বেশি প্রমোদ-কর পাওয়া সুনিশ্চিত বলে প্রস্তাবে বলা হয়েছে।
কিন্তু সেট টপ বক্সের বিরুদ্ধে খোদ রাজ্য সরকারেরই জেহাদের জেরে সেই বাড়তি আয়ের আশা আপাতত বিশ বাঁও জলে। কেব্ল টিভি থেকে প্রমোদ-কর আদায় হয় কী ভাবে?
কেব্ল টিভির গোড়ার দিকে সম্প্রচারকারী সংস্থারা সরাসরি কেব্ল অপারেটরদের কাছে জানতে চাইত, তাঁরা ক’জনকে কেব্ল-সংযোগ দিয়েছেন। সেই হিসেবে অপারেটরের থেকে প্রমোদ-করের টাকা নিয়ে সরকারের ভাঁড়ারে জমা দেওয়া হতো। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে অপারেটরেরা সংযোগের সংখ্যা কমিয়ে দেখায় বলে অভিযোগেরও অন্ত ছিল না। “কেউ চারশো কানেকশন দিলে দেখাত চল্লিশ। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে আসল সংখ্যাটা জানাও সম্ভব হতো না।” বলেন এক সর্বভারতীয় টিভি কোম্পানির মুখপাত্র। পরে পে চ্যানেলের জমানা এলে গড়ে ওঠে ত্রিস্তরীয় কাঠামো মাল্টি সিস্টেম অপারেটর (এমএসও), তার নীচে অপারেটর, তার নীচে অসংখ্য সাব-অপারেটর। তখন সংযোগ প্রচুর বেড়ে গেলেও সাব-অপারেটর, অপারেটর থেকে এমএসও-র হাত ঘুরে টিভি কোম্পানির আদায়ের পরিমাণ আরও কমে যায়। আরও মার খেতে থাকে সরকারের রাজস্ব আদায়।
এ দিকে কেন্দ্র ১৯৯৬-এ কেব্ল ব্যবসায় পরিষেবা-কর বলবৎ করে। পশ্চিমবঙ্গেও কেব্ল সংযোগপিছু প্রমোদ-কর আদায়ের বিজ্ঞপ্তি জারি হয় ১৯৯৮-এ। নিয়ম অনুযায়ী, শহরাঞ্চলে প্রতিটি টেলিভিশনে কেব্ল সংযোগের জন্য অপারেটরকে মাসে ১০ টাকা প্রমোদ-কর বাবদ জমা দিতে হবে। গ্রামাঞ্চলে ৫ টাকা। অপারেটর সংগঠন ও সরকারের প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী, কলকাতা মেট্রো এলাকায় ৪২ লক্ষ টেলিভিশনে কেব্ল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বছরে সরকারের রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা ৫০ কোটির বেশি।
কিন্তু বাস্তবে আসছে মেরেকেটে চার কোটি! দফতর-সূত্রের খবর: গত অর্থবর্ষে ডিরেক্ট টু হোম (ডিটিএইচ) থেকে প্রমোদ-কর মিলেছে প্রায় ১২ কোটি। অথচ কেব্লের তুলনায় ডিটিএইচ কানেকশনের সংখ্যা নগণ্য। তবু আয় এত বেশি কেন?
কারণ, ডিটিএইচ-গ্রাহকের সংখ্যা এক লহমায় জানা যায়। “কিন্তু ক’টা বাড়িতে ক’টা টিভিতে কেব্লের লাইন আছে, আমরা তা তো জানি-ই না, এমনকী ক’জন অপারেটর কেব্লের ব্যবসা করেন, তা-ও জানা নেই।” আক্ষেপ এক অর্থ-কর্তার। তাঁর মন্তব্য, “এ সত্ত্বেও কেব্ল থেকে বছরে চার-সাড়ে চার কোটি টাকা সরকার পাচ্ছে। ঠিকঠাক ব্যবস্থা থাকলে আদায়টা বহু, বহু গুণ বাড়ত।”
অপারেটরদের আয়ের বহরটা কেমন? সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় সরকার কেব্ল-আইন মেনে চার মেট্রো শহরে কন্ডিশনাল অ্যাকসেস সিস্টেম (ক্যাস) চালু করেছিল ২০০৬-এর ৩১ ডিসেম্বর। এ জন্য কলকাতাকে চারটি ‘জোনে’ ভাগও করা হয়। কিন্তু কেব্ল অপারেটরদের বিরোধিতার মুখে পড়ে তদানীন্তন বাম সরকার পিছিয়ে আসে। শুধু বেহালা আসে ক্যাসের আওতায়। বেহালার একটি অঞ্চলের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, আগে যেখানে দশ জন সাব-অপারেটরের ১২৯৬টি সংযোগের দৌলতে এক অপারেটরের মাসে ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা আয় হতো, চলতি বছরে প্রায় দু’ডজন সাব-অপারেটর মারফত তা দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ!
হিসেবটা অর্থ দফতরের প্রমোদ-কর বিভাগেরও অজানা নয়। কিন্তু স্রেফ পরিকাঠামোর অভাবে তাঁরা এই বিপুল ব্যবসা থেকে যথাযথ পরিমাণে কর আদায় করতে পারছেন না বলে অর্থ-কর্তাদের দাবি। সিটি কেব্লের ডিরেক্টর সুরেশ শেঠিয়া বলেন, “সাব-অপারেটরদের থেকে কানেকশনের সংখ্যা জেনে মূল অপারেটরেরা যে হিসেব দেন, তার ভিত্তিতে আমরা কেন্দ্রকে পরিষেবা-কর দিই। এ ছাড়া ফি বছর পুরসভাকে প্রমোদ-কর দিই।” ফোরাম অফ কেব্ল অপারেটর্স-এর সুভাষ নাগ বলেন, “বহু সাব-অপারেটর কানেকশন অনেক কম দেখান। সেটাই আমরা এমএসও-দের জানাতে বাধ্য হই। ফলে সরকারও ন্যায্য কর থেকে বঞ্চিত হয়।”
সরকারি-কর্তাদের একাংশের দাবি, এই সমস্যার সুরাহা হতে পারত সেট টপ বক্স। যার সুবাদে কেব্ল গ্রাহকের সংখ্যা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকত না। অর্থ দফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের হাতে কলকাতায় ১৩০০ এবং জেলায় ১৪০০ মূল অপারেটরের তালিকা রয়েছে।
এক আধিকারিকের কথায়, “ওঁদের থেকে সিগন্যাল নিয়ে লাখেরও বেশি সাব-অপারেটর ব্যবসা করছেন। সেট টপ বক্স পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে প্রতিটি কানেকশনের হিসেব কম্পিউটারে এসে যাবে। সেই ব্যবস্থা করতে পারলে বছরে সাড়ে তিনশো কোটিরও বেশি টাকা হেসে-খেলে তুলতে পারতাম।”
আয়ের পথে বাধা কবে সরবে, ওঁরাও তা জানেন না।
|
লোকসানের অঙ্ক |
• কলকাতা মেট্রো এলাকায় কেব্ল সংযুক্ত টিভি ৪২ লক্ষ
• সংযোগ পিছু মাসিক প্রমোদ কর ১০ টাকা
• বছরে আদায় হতে পারত ৪২ লক্ষ X ১০ X ১২= ৫০ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা
• এখন আদায় হচ্ছে ৪ কোটি |
|