|
|
|
|
|
|
|
ভাল কাজ |
মধুমিতা ঘোষ |
টুপুর আজ খুব গম্ভীর। স্কুল থেকে ফিরে জামাকাপড় ছাড়েনি। অন্যান্য দিনের মতো হুটোপাটি করছে না। এমনকী টিভিতে কার্টুন চ্যানেলও দেখছে না। ঠাকুমা পাশে এসে বসলেন। টুপুর কিন্তু ঠাকুমার দিকে ফিরেও তাকাল না।
ঠাকুমা টুপুরের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কী হয়েছে টুপুরসোনা? আজ যে দেখছি মুখটা অমাবস্যার মতো অন্ধকার। স্কুলে পড়া পারোনি?
টুপুর ঘাড় নাড়ল। ঠাকুমা বললেন,
তা হলে?
টুপুর চিন্তিত মুখে বলল, আজ মিস আমাদের একটা হোমওয়ার্ক দিয়েছেন। সামার ভেকেশনে করতে হবে।
ঠাকুমা কৌতূহলী হয়ে বললেন,
কী হোমওয়ার্ক?
টুপুর বিজ্ঞের মতো ঘাড় নেড়ে বলল, খুব শক্ত। আমাদের ভেকেশন মোটে কুড়ি দিন। এই কুড়ি দিন প্রতিদিন কী করলাম, তা একটা খাতাতে লিখে রাখতে হবে। তার মধ্যে অবশ্যই দশটা ভাল কাজ করার কথা থাকবে। মিস কিন্তু বার বার বলেছেন, ইউ শুড বি অনেস্ট। অ্যানুয়াল ডে-র দিনে এগ্জিবিশন হবে। ওই দিন প্রত্যেকের খাতা খুলে দেখা হবে। যার কাজের লিস্ট মিসদের
সবচেয়ে ভাল লাগবে, ঠিক মনে হবে, সে পুরস্কার পাবে।
ঠাকুমা টুপুরকে বললেন, বাঃ, এ তো ভাল কথা। তা হলে সমস্যাটা কোথায়?
টুপুর ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, আমি কী ভাল কাজ করি শুনি! এই তো গত কালই মা অফিস থেকে ফিরে বললেন, টুপুরটা দিন দিন অবাধ্য হচ্ছে। টিভিতে শুধু কার্টুন চ্যানেল চালিয়ে দেখবে। পড়বে তো লেখা প্র্যাক্টিস করবে না। খাতাগুলো বানান ভুলে ভরা। পড়ার টেবিলটাও গুছিয়ে রাখবে না। একটা ভাল কাজ যদি ও করে থাকে।
ঠাকুমা হেসে বললেন, ও এই কথা। আর তো ক’দিন পরেই গ্রীষ্মের ছুটি পড়ছে। কুড়ি দিনের মধ্যে দশটা ভাল কাজ ঠিক হয়ে যাবে। আসলে জানবি, কাজ করার ইচ্ছে থাকলে কাজ আপনা-আপনিই ধরা দেয়। এখন ওঠ তো। হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নে।
টুপুরের বয়স ন’বছর। ক্লাস ফোরে পড়ে। টুপুরের বাবা-মা দু’জনেই চাকরি করেন। তাই স্কুল থেকে ফিরে ও ঠাকুমার কাছেই থাকে। ওর যত গল্প ঠাকুমার সঙ্গেই। বিকেলে ক্যাম্পাসের পার্কেই খেলতে যায়। পার্কে কার সঙ্গে টুপুরের ঝগড়া হয়েছে, কাকে ওরা খেলা থেকে বাদ দিয়েছে, কী খেলা খেলেছে এ সব কথাই ঠাকুমাকে বলে।
গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রথম থেকেই ঠিক করা ছিল পুরীতে যাওয়া হবে। টিকিট কাটা আছে। পুরীতে মোট পাঁচ দিন থাকবে।
এত দিন পুরী যাওয়া নিয়ে টুপুর আনন্দ-উত্তেজনায় ছটফট করছিল। কিন্তু ভাল কাজ করার দায়িত্ব যখন থেকে চেপে বসেছে,
ও যেন আনন্দটাকে পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করতে পারছে না। ফিসফিস করে ঠাকুমাকে বলল, ঠাকুমা পুরীতেই তো পাঁচ দিন কেটে যাবে, তা হলে বাকি থাকবে পনেরো দিন। দশটা ভাল কাজ ওই পনেরো দিনের মধ্যে করতে পারব তো?
ঠাকুমা টুপুরের কথায় হেসে ফেললেন। তার পর বললেন, বোকা মেয়ে, ভাল কাজটা বুঝি শুধু কলকাতাতেই করা যায়। ভাল কাজ সব সময় সব জায়গাতেই করা যায়। তবে এটাও ঠিক, তোদের মিস যেমন বলেছেন, সেই মতো চলবি। মানে কোনটা ভাল কাজ তা কিন্তু তোকেই বুঝে নিতে হবে।
ট্রেনে শুয়ে টুপুরের প্রথমে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। চোখ বুজলেই পুরীর নীল সমুদ্র চোখের সামনে ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ পরেই টুপুর দেখল, ওর উল্টো দিকের বার্থে এক বয়স্ক ভদ্রলোক শুয়ে একনাগাড়ে কেশে যাচ্ছেন। টুপুর টুক করে বাঙ্ক থেকে নামল। ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে বলল, দাদু, একটু জল খাবে? বয়স্ক মানুষটি কাশতে কাশতে ইশারা করে হুকে ঝোলানো ব্যাগটা দেখালেন। টুপুর চট করে ব্যাগ থেকে বোতলটা বার করে ভদ্রলোকের হাতে দিল। ভদ্রলোক জল খেয়ে ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘বা রে, তুমি তো খুব ভাল মেয়ে। এত ছোট অথচ এই বয়স থেকেই মানুষকে হেল্প করতে শিখেছ। বাঃ, খুব ভাল।’ |
|
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার |
প্রশংসা পেয়ে টুপুরের মনে হল, তা হলে ও কি ভাল কাজ করল? এই কাজের কথাটা ও খাতায় লিখে রাখবে।
সকালবেলাতেই ট্রেনটা পুরীতে পৌঁছল। হোটেল বুক করাই ছিল। স্টেশন থেকে রিকশা করে যেতে যেতেই টুপুর সমুদ্র দেখতে পেল। আর ওদের হোটেলটাও একদম সমুদ্রের সামনে। দুপুরে বাবার হাত ধরে সমুদ্রে টুপুর নেমেও ছিল।
ওদের হোটেলের সামনেই একটা অন্ধ ভিখারি বসে ভিক্ষা করত। টুপুর ওর বাবার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে ভিখারিটাকে দিল। পরের দিনও টুপুর পয়সা দিতে গিয়ে দেখল, ভিখারিটার বাঁ হাতের ওপরে ঘা হয়েছে। দুপুরে টুপুর হোটেল থেকে খেয়ে ফেরার সময় বলল, আচ্ছা মা, নতুন চটি পরে তোমার পায়ের ফোস্কাটা ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল না! ডাক্তার আঙ্কেল যে মলমটা দিয়েছিলেন, ওটা আছে? ওর মা অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ, এখনও তো আমাকে ওষুধটা রোজ লাগাতে হয়। তো?
টুপুর ইতস্তত করে বলল, মা, মলমটা আমায় দেবে? ওই অন্ধ ভিখারিটারও না তোমার মতো ইনফেকশন হয়েছে। তবে ওর হাতে হয়েছে। মলমটা যদি ওকে দিই, ও-ও হাতে লাগাতে পারবে।
টুপুরের মা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ টুপুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পর হেসে বললেন, বাঃ, এ তো খুব ভাল কথা। ঠিক আছে আজ বিকেলে বেরিয়ে ওই ওষুধটা কিনে দেব। দিবিই যখন, তখন নতুনটা দিস। তা হলে ও অনেক দিন ধরে হাতে লাগাতে পারবে। ওষুধটা সত্যিই ভাল।
স্কিন ডিজিজে খুব ভাল কাজ দেয়।
টুপুর হেসে ঘাড় নাড়ল। মনে মনে ভাবল, ভাল কাজের লিস্টে কথাটা লিখে রাখতে হবে তারিখ দিয়ে।
পুরী থেকে ফিরে পর দিন টুপুর পার্কে খেলতে গেল। এই ক্যাম্পাসে শুধু উজ্জয়িনী ওর স্কুলে পড়ে। একই ক্লাসে। টুপুরের ভাল নাম দেবাঙ্কি। ওকে দেখে উজ্জয়িনী বলল, হ্যাঁ রে দেবাঙ্কি, এই ক’দিনের মধ্যে ক’টা ভাল কাজ করেছিস?
টুপুর ঠোঁট উল্টে বলল, এখনও পর্যন্ত মোটে দুটো। তুই? উজ্জয়িনী হেসে বলল, আমার তো অলরেডি পাঁচটা হয়ে গিয়েছে। টুপুর অবাক হয়ে বলল, ও মা তাই!
কী কী রে?
উজ্জয়িনী বলল, এই তো রান্নার মাসির মেয়েটা ছেঁড়া জামা পরে এসেছিল। ওকে আমি আমার একটা ফ্রক দিলাম। ড্রাইভার আঙ্কেলের হাত কেটে গিয়েছিল। আমি ব্যান্ডএইড লাগিয়ে দিলাম। টবের গাছগুলোয় রোজ দু’বেলা জল দিচ্ছি। সিকিউরিটি গার্ডের গোমড়া মুখটা আগে দেখলেই আড়ালে ভেংচি কাটতাম। এখন ঘাড় নেড়ে হাসি। গত কাল দুপুরে মায়ের খুব মাথাব্যথা হয়েছিল, মাথা টিপে দিয়েছিলাম।
টুপুর অবাক হয়ে শুনছিল উজ্জয়িনীর কথা। তাই তো, এই কাজগুলো তো টুপুরও অনায়াসে করতে পারে। পুরী যাওয়ার সময় ভারী সুটকেসটা বাবা একাই টানছিলেন। টুপুরও একটু হাত লাগাতে পারত। ঠাকুমা পান খান। প্রতিদিন হামানদিস্তায় সুপুরি থেঁতো করেন। দাঁত নেই তো, তাই শক্ত সুপুরি চিবোতে পারেন না। টুপুর দেখে সে সময় ঠাকুমা হাঁপান। ইস্ টুপুর তো অনায়াসে সুপুরিটা থেঁতো করে দিতে পারে। এই তো সে দিন ভারী টেবিলটা সরাতে গিয়ে বাবার হাতে লেগে গেল। মা তাড়াতাড়ি ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে লাগিয়ে দিলেন। ওই কাজটা তো টুপুরও করে দিতে পারত। ওদের ব্যালকনিতেও তো কত গাছ আছে। মা সকালে রোজ জল দেন। বাবাও মাঝে মাঝে দেন। তা হলে টুপুরও তো রোজ দিতে পারে। ইস্, মিস তো কত বার বলেছেন,
চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। এটা তো খেয়াল ছিল না।
পার্ক থেকে ফিরেই টুপুর নিজে থেকে হাত-পা ধুয়ে পড়তে বসে গেল। ওর সামনে এখন অনেক ভাল কাজ। মিস তো মাত্র দশটা ভাল কাজের কথা বলেছেন। যদি মিস আরও বেশি ভাল কাজের কথা বলতেন তো টুপুর অনায়াসেই করতে পারত। এখন ও ভাল কাজ কাকে বলে বুঝতে পারছে। |
|
|
|
|
|